ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন বই হাতে নতুন স্বপ্ন চোখে শিশুরা

নতুন বই হাতে নতুন স্বপ্ন চোখে শিশুরা
ছবি: সংগৃহীত

বছরের প্রথম দিন গতকাল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল পরম আনন্দের। উত্তীর্ণ হয়ে নতুন শ্রেণিতে উঠেছে তারা। কোমলমতি শিশু-কিশোররা খালি হাতে স্কুলে গেছে আর নতুন ঝকঝকে তকতকে বই নিয়ে ঘরে ফিরেছে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে। নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণের উচ্ছ্বাস আর নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দ দুয়ে মিলে খুশির বন্যা বয়ে গেছে দেশের প্রতিটি স্কুলে। নতুন বইয়ের সোঁদা গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছে শিশু-কিশোররা। কোমল প্রাণের যত স্বপ্ন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে নতুন বইয়ের পাতার ভাঁজে।

তবে এমন উৎসবের দিনে শতভাগ বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। অনেকেই আবার ফিরেছে খালি হাতে। যে কারণে মন খারাপ করেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাদের। ঢাকার বাইরে প্রাথমিকের একটি বইও পায়নি এমন স্কুলও আছে। এ ছাড়াও বইয়ের কাগজ, বাঁধাই ও ছাপার মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

ঢাকার দক্ষিণ মুহসেন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাজাহান কবীর গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির একটি বইও আসেনি। মাধ্যমিকে কোনো শ্রেণিতেই পুরো সেট বই পাওয়া যায়নি। প্রতিটি শ্রেণির দুটি কিংবা তিনটি বই দিয়ে পাঠ্যপুস্তক উৎসব করা হয়েছে।

টিকাটুলি কামরুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির জান্নাতুল ফেরদৌসেরও মন খারাপ। বছরের প্রথম দিন স্কুলে এসেছে বই নিতে। কিন্তু তার ক্লাসে বই দেওয়া হয়নি। বই দেওয়ার তারিখ পরে জানানো হবে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

ঢাকার বেশকিছু স্কুলের শিক্ষকরা জানান, ঢাকা মহানগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সব শ্রেণির বই পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো শ্রেণির একটি বইও পাওয়া যায়নি এমনও আছে। অধিকাংশই নিউজ প্রিন্টের নিম্নমানের কাগজে তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এবার কাগজ সংকটের কারণে শতভাগ বই স্কুলগুলোতে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ৮০ শতাংশ বই সারা দেশে পাঠানো হয়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বাকি বই পাঠানো হবে।

নিম্নমানের বইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নজরে এখনও এ ধরনের বিষয় আসেনি। এমন কাজ কেউ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে রোববার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ফটক দিয়ে ঢুকতেই কানে ভেসে আসে শিশু-কিশোরদের আনন্দের প্রতিধ্বনি। শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে তখনও সূর্য ওঠেনি। সবুজ মাঠজুড়ে হাজার হাজার শিশু। মাথায় তাদের বই উৎসবের ক্যাপ। শিশুদের কলরবে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকরাও। ঢাকঢোল আর ব্যান্ড দলের বাজনা উৎসবকে পুরোপুরি মাতিয়ে দেয়। পাঠ্যপুস্তক উৎসবের কেন্দ্রীয় এ আয়োজন উপলক্ষে রংবেরঙের পতাকা আর ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হয়। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু এ অনুষ্ঠানে রঙিন বেলুন উড়িয়ে উৎসব উদ্বোধন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। একই চিত্র ছিল দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুখর হয়ে ওঠে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে।

বই বিতরণ উৎসবের অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, এ বছর ২ কোটি ১৮ লাখ ৩ হাজার ৩০ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ইতিমধ্যে সব স্কুলে নতুন বই পৌঁছে গেছে। প্রেসের কারণে হয়তো দুয়েক সেট কম থাকতে পারে।

এবারের ‘বই সংকটের’ কারণ ব্যাখ্যা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে কাগজ সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার জন্য সঠিক সময়ে পূর্ণাঙ্গ বই প্রেসগুলো দিতে পারেনি। প্রায় ৮০ ভাগ বই আমাদের দিয়েছে। আমরা এ মাসের মধ্যে সারা দেশে শতভাগ বই দিতে পারব। শিশুদের ‘স্মার্ট নাগরিক’ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টুর্নামেন্ট থেকে উঠে আসা সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলের স্বপ্না রানী, সাথী বিশ্বাস ও সাজেদা খাতুনসহ পাঁচ সদস্যকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, এমপি বেগম শিরীন আখতার, বেগম ফেরদৌসী ইসলাম ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে গাজীপুরের কাপাসিয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপর শিক্ষার্থীদের হাতে তিনি বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেন।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, কাগজের আর কোনো সংকট থাকবে না, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সবাই বই পেয়ে যাবে। ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বই দেওয়া হয়েছে।

বিনামূল্যের বই উৎসব পৃথিবীর অনেক দেশে অচিন্তনীয় বলে মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বে বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, বাংলাদেশে বই উৎসব হয়। কোটি কোটি শিক্ষার্থী এই উৎসবে অংশ নেয়। এটি পৃথিবীর যেকোনো জায়গার জন্য একটি অচিন্তনীয় ব্যাপার। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আমরা রোধ করতে পেরেছি। কারণ মা-বাবার ওপর এই বই কেনার ভার আর থাকছে না।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা নতুন বই হাতে পায়, এই নতুন বইয়ের ঘ্রাণের কথা সবাই বলেছেন। আমাদের ছোটবেলায় আমাদের এত সৌভাগ্য হয়নি। তিন থেকে ছয় মাসও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে নতুন বই কেনার জন্য। অনেকসময় সারা বছরই পুরোনো বই পড়ে আমাদের পার করতে হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা যদি তোমাদের মতো ছোট হতে পারতাম! বছরের প্রথমদিন বই নিয়ে আনন্দ করতে পারতাম! উৎসবে শামিল হতে পারতাম! তবে তোমাদের আনন্দেই আমাদের আনন্দ।

এ বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের আর ‘পরীক্ষা ভীতিতে’ থাকতে হবে না বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, পরীক্ষা থাকবে, তবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে একটা বিরাট অংশ হবে। কোনো মুখস্থ বিদ্যার বালাই থাকবে না। সক্রিয় শিখন হবে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন হবে। যা শিখবে তা আবার প্রয়োগ করতে শিখবে। কেমন করে শিখতে হয়, তাও শিখে ফেলবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে বই উৎসবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, স্থানীয় এমপি সিমিন হোসেন রিমি, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

এবার ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৩ কোটি ৯১ লাখ ১২ হাজার ৩০০ কপি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার মোট ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে।

বছরের প্রথম দিন ঘটা করে বই উৎসব হলেও এবার শিক্ষার্থীদের হাতে পুরো সেট বই তুলে দেওয়া যায়নি। কাগজ ও কালির সংকট, ঊর্ধ্বমুখী দাম, ছাপা সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং, দুটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও এনসিটিবির কার্যাদেশে দেরি ইত্যাদি কারণে বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন বই
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত