ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মেট্রোরেল : নাজুক নিরাপত্তায় নাখোশ যাত্রীরা

মেট্রোরেল : নাজুক নিরাপত্তায় নাখোশ যাত্রীরা

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা। মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশন। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে, এক পুলিশ ও দুই আনসার সদস্য বসে আছেন। যাত্রীরা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠছেন। ওঠা-নামায় কোনো নিয়মের বালাই দেখা যায়নি। যে যার মতো উঠছেন-নামছেন। দ্বিতীয় তালয় উঠে চোখে পড়ে টিকেটের জন্য বিশাল লাইন। অনেক মানুষের ভিড়। এরই মধ্যে কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। আবার কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটছেন। এখানে স্কাউট সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে যাত্রী ও সাধারণ মানুষকে শৃঙ্খলা মানতে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। টিকেট কেটে তৃতীয় তলায় উঠেও চোখে পড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। সেখানেও স্কাউট সদস্যরা মানুষকে নিয়ম মানাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাদের অনুরোধ কোনো গুরুত্বই পায়নি যাত্রী-সাধারণের কাছে। গতকাল আগারগাঁও ও উত্তরায় মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থার এমন চিত্র দেখা গেছে। এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল উদ্বোধনের পরদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

চালুর প্রথম দিন থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসছে মেট্রোরেল দেখতে ও চড়তে। বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, আবার কেউ একা এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। যাত্রীদের চেয়ে দর্শক ও উৎসুক মানুষজনই বেশি ভিড় করছেন। এসব উৎসুক মানুষ নিজেরা ভাইরাল হতে মেট্রোরেলের সিট, হাতল ও বডিতে আঁকাআঁকি করছেন। নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণার পোস্টারে ছেয়ে সৌন্দর্য হারিয়েছে পিলারগুলো। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মেট্রোরেলে নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতিই বেশি নজরে পড়েছে যাত্রীদের। যাত্রীদের ভাষ্য, স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী নেই, আর হাতে গোনা যে কজন রয়েছেন নিয়ম-শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে তারাও উদাসীন।

মেট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব এমআরটি পুলিশের হলেও এখনও সেই বাহিনী গঠন সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে স্থানীয় থানা পুলিশ ও রিজার্ভ পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। তবে গতকাল সকাল থেকে মেট্রোরেলের আগারগাঁও ও উত্তরা স্টেশন ঘুরে পুলিশ সদস্যের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্ব পালনরত একজন কনস্টেবল গণমাধ্যমকে বলেন, এমআরটি পুলিশ যতদিন না হয়, ততদিন রিজার্ভ পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশ মেট্রোরেলে ডিউটি করবে। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে ১৫ পুলিশ সদস্য ডিউটি করছেন। এর সঙ্গে আনসার ২২ জন আনসার সদস্য ও ২৫ জন রোভার স্কাউট সদস্য রয়েছেন। তারাই এখন আগারগাঁও মেট্রোরেলের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর এই সদস্য আরও বলেন, অনেক মানুষ মেট্রোরেলে ঘুরতে আসে। তাদের নিরাপত্তা ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছি আমরা। তবে কারো সন্দেহজনক হলে আমরা তাকে চেক করি। আর ঘুরতে আসা লোকদের কারণে একটু হইচই হয়। তবে নিরাপত্তায় কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।

বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় উত্তরা মেট্রো রেলস্টেশনে দেখা যায়, মেট্রোরেল থেকে তৃতীয় তলায় নামার পরই সবাই হৈ-হুল্লোড় করে নিচে নামছে। দ্বিতীয় তলায় লম্বা লাইন। মেট্রো কার্ড পাঞ্চের তিনটা মেশিনের দুটি ব্যবহার করছিলেন যাত্রীরা। আর একটি পাঞ্চ মেশিন মেরামত করছিলেন কর্মীরা। কয়েকজন আনসার সদস্য যাত্রীদের বের হওয়ার পথ দেখাচ্ছিলেন। তবে ওই স্টেশনে মাত্র একজন পুলিশ সদস্য দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এখানে পুলিশের ১৫ সদস্য কাজ করছেন। দুপুর প্রায় ১২টা বাজার কারণে তারা একটু ঘোরাঘুরি করছেন। গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু পুলিশ সদস্য নাস্তা করতে গেছেন। তাই এখন আর ঝামেলা নেই।

তবে মেট্রোরেলের উত্তরা ও আগারগাঁও স্টেশন দুটির কোনোটিতেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা চোখে পড়েনি। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যরা স্টেশনের প্রবেশমুখে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো ধরনের তল্লাশি ছাড়াই স্টেশনে ঢোকে যাত্রী ও ঘুরতে আসা মানুষেরা। প্রবেশমুখগুলোয় নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য কোনো মেটাল ডিটেক্টর চোখে পড়েনি। এ ছাড়া ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করলেও তল্লাশি কিংবা স্ক্যানের কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। অনেকেই ব্যাগ নিয়ে টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়ান। কোনো ধরনের তল্লাশিব্যবস্থা না থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটির জন্য নিরাপত্তা ঘাটতি মনে করেন অনেক যাত্রী।

বাড্ডা থেকে আসা রাকিব গণমাধ্যমকে বলেন, স্টেশনে ঢোকার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একসময় প্রবেশমুখের কেচিগেট খুলে দিল, আমরা ঢুকে পড়লাম। কোনো আর্চওয়ে গেট কিংবা মেটাল ডিটেক্টর ছিল না। দ্বিতীয় তলায়ও নিরাপত্তাব্যবস্থা চোখে পড়েনি। মিরপুর থেকে আসা তানভির রহমান বলেন, নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। এত টাকা খরচ করে সরকার উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে, এসব বিষয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আনা উচিত ছিল।

আগারগাঁও স্টেশনে দায়িত্বরত প্রকৌশলী রাকিব গণমাধ্যমকে বলেন, এমআরটি পুলিশ তৈরি হয়ে গেলে নিরাপত্তা সমস্যা থাকবে না। পিলারে পোস্টার লাগানো দ-নীয় অপরাধ। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

মেট্রোরেলের এআরও জাকারিয়া সময়ের আলোকে বলেন, সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশকে বলা হয়েছে। স্টেশনের গেটে আনসার ও পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন এবং ভেতরে মেট্রোরেলের কর্মী ও রোভার স্কাউটরা সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া প্ল্যাটফর্মের সহায়তার জন্য আরও কয়েকটি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। গেটে এখন পর্যন্ত কোনো আর্চওয়ে বা মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়নি। ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নিরাপত্তার বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় পুলিশ, আনসার ও নিজস্ব ফোর্স নিযুক্ত রয়েছে। সাধারণত যাত্রী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি এবং সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা কমে বা বাড়ে। লোকজন কম থাকলে ১০ জন আবার বেশি থাকলে ২৫ জন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়াও ২৫ জন করে স্কাউট সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বলেন, মেটাল ডিটেক্টর, ফেস ডিটেক্টরসহ সবকিছুই আমাদের আছে। যদি পরিস্থিতি এমন হয় এসব যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, তখন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতরা এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করবেন। তেমনি কখনো পরিস্থিতি ক্রিটিক্যাল হলে পুলিশ বা অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে।

মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টারিং নিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন মাইকিং বা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সচেতন করছে। এ ক্ষেত্রে যাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজ উদ্যোগে সচেতনতা তৈরি করা খুবই জরুরি। মানুষ ধীরে ধীরে সচেতন হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে।

মেট্রোরেল
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত