ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিদেশে অপপ্রচার রোধে তৎপর রাষ্ট্রদূতরা

বিদেশে অপপ্রচার রোধে তৎপর রাষ্ট্রদূতরা

দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সব কূটনীতিককে সতর্ক থাকতে বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশের বিরুদ্ধে বিদেশে অপপ্রচার ছড়ানো রোধে বিদেশে সব রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন বছরের শুরুর দিনে তাদের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এই নির্দেশনা দেন। ওই নির্দেশনার পর কে বা কারা অপপ্রচার ছড়াচ্ছে তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশ মিশনের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা। ইতিমধ্যে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তিনি দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত সেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবশ্য আইনি জটিলতার কারণে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশেই অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নির্দেশনা নতুন কিছু নয়, আগেও কূটনীতিকদের প্রতি এমন নির্দেশনা ছিল। তবে মাঝে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভাটা পড়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন করে আবার এই নির্দেশনা দেন। গত এক জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের সঙ্গে নতুন বছরের পরিকল্পনা এবং এর আগে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা বৈঠকে অপপ্রচার রোধে মৌখিকভাবে এই নির্দেশনা দেন।

আগে দেশের বিরুদ্ধে বিদেশে বিদ্বেষমূলক, কুরুচিপূর্ণ ও ঘৃণার মন্তব্য ছড়ানো সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আগে জানাতেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন নির্দেশনায় বলেছেন যে এমন ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে না থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবেন এবং এরপর মন্ত্রণালয়কে জানাবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিদেশে অনেকেই দেশ সম্পর্কে মিথ্যা বানোয়াট তথ্য বা অপপ্রচার চালায়। সে সম্পর্কে তাদেরকে বলেছি যে এমন ঘটনা ঘটলে আপনারা ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। মিথ্যা বা অপপ্রচার দেখেন সঙ্গে সঙ্গে আপনারা ব্যবস্থা নেবেন। এমন ঘটনায় আপনারা মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না, মন্ত্রণালয় বলার পরে আপনারা ব্যবস্থা নেবেন এগুলো ভুলে যান, এগুলো পুরোনো চর্চা। আমরা নবদিগন্তে প্রবেশ করেছি এবং আমরা বিশ্বাস করি যে আপনারা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল লোক, আপনারা সেই অনুযায়ী কাজ করবেন যা আপনারা ভালো মনে করেন।

এদিকে বছরের শুরুর দিনে অপপ্রচার রোধ সংক্রান্ত একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ওই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। ওই কমিটি মূলত অপপ্রচার বা মিথ্যা তথ্য সংক্রান্ত ঘটনা প্রতিকারে কাজ করবে। দেশের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনাররা অপপ্রচার বা এমন ঘটনায় যেসব ব্যবস্থা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করবেন, ওই রিপোর্ট এই কমিটিকেও পাঠানো হবে এ কমিটি ওই রিপোর্ট নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ করবেন। প্রয়োজনবোধে ওই কমিটি বিদেশের যে স্থানে এমন ঘটনা ঘটবে প্রতিকারের জন্য ওই দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা চাইবেন। এ ছাড়া ওই কমিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করা অপপ্রচার বা মিথ্য তথ্য প্রকাশের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন।

কূটনীতিকরা জানান, দেশের বিরুদ্ধে বিষোদগাররোধে তারা সবসময়েই তৎপর। নতুন এই নির্দেশনার পর তারা আরও তৎপর হবেন। দেশের বিরুদ্ধে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে যেসব সোর্স বা মাধ্যম থেকে এমন ঘটনা হবে সেসব সোর্স বা মাধ্যমে প্রথমে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনাররা প্রতিবাদ বা সঠিক তথ্য সরবরাহ করবেন এবং সুযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রাচার বিভাগকেও জানানো হবে। তবে সব দেশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এমন প্রতিবাদ জানানো কঠিন হবে। উদাহরণ হিসেবে এক কূটনীতিক জানান যে, গত বছর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় ইউরোপের একটি দেশে পদ্মা সেতু ঘিরে দুর্নীতির যে মামলা হয়েছিল তা কেন্দ্র করে সেখানে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়।

বিষয়টি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের নজরে এলে তিনি দূতাবাসের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে ধরেন। কিন্তু ওই দেশের বাক-স্বাধীনতা আইন এমন যে কেউ ভুল তথ্য ছড়ালেও প্রতিবাদ করা যাবে না এবং প্রতিবাদ করলে উল্টো ফল হতে পারে। যে কারণে ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রাচার বিভাগকে বিষয়টি অবহিত না করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের যোগাযোগমাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচারে সীমিত থেকেছেন। আবার অনেক দেশ আছে যে সেসব দেশে মিথ্যা তথ্য ছড়ালে ওই দেশের রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। কূটনীতিক সূত্রগুলো আরও জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাজ্য এবং কানাডা এই দুটি দেশেই বেশিরভাগ সময়ে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার এবং বিদ্বেষমূলক, কুরুচিপূর্ণ ও ঘৃণার মন্তব্য ছড়ানো হয়। কিন্তু যুক্তরাজ্যের আইন অনুসারে ওই দেশে এমন ঘটনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কানাডায় এ-সংক্রান্ত একটি আইন সংশোধনের পথে রয়েছে। আইনটি পূর্ণাঙ্গ সংশোধনের পর এমন ঘটনায় ওই দেশে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

এদিকে যেসব কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি, দেশ সম্পর্কে গুজব, মিথ্যা এবং বিকৃত তথ্য প্রচার করবে তাদের পাসপোর্ট, ভিসা ইস্যুসহ কোনো ধরনের সেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কানাডায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন। কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলীলুর রহমান এই তথ্য জানিয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, যারা বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে কুৎসা ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে, অপপ্রচার, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে তারা দূতাবাসের পর্যবেক্ষণে রয়েছে এবং তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কানাডার স্থানীয় আইনে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়টিও পর্যালোচনা করছি। এই বিষয়ে প্রতিনিয়ত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পরামর্শ নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অর্থ পাচার বা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত তাদের পাসপোর্ট, ভিসা ইস্যুসহ কোনো ধরনের সেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কানাডায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন।

সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেহেদী হাসান এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধে এবং ভাবমূর্তি রক্ষায় সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাস সবসময়ই তৎপর। তবে এখানে খুব বেশি বাংলাদেশি বসবাস করে না, মাত্র ১৮ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। অন্য দেশের মতো সুইডেনে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তেমন একটা হয় না।

ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্রুনাইয়ে যেসব বাংলাদেশি বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক শ্রেণির, তারা আসলে এত পরিশ্রমের মধ্যে থাকেন যে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো সংক্রান্ত ঘটনায় জড়িত হওয়ার সময় পান না এবং এখানে এমন ঘটনা একদমই ঘটে না। তারপরও এই বিষয়ে হাইকমিশন শতভাগ সতর্ক ও তৎপর রয়েছে। এমন ঘটনা কখনো ঘটলে যেখান থেকে সূত্রপাত প্রথমে সেখানে প্রতিবাদ জানাব এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করব। এরপর প্রয়োজনে ব্রুনাইয়ের রাষ্ট্রাচার বিভাগকে জানাব এবং তাদের সহযোগিতা নেব।

রাষ্ট্রদূত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত