দুই মাসে ঠান্ডাজনিত রোগে ৭৬ মৃত্যু, ৭৫ জনই শিশু

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

  অনলাইন সংস্করণ

সংগৃহীত

দেশে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। পৌষের মাঝামাঝি সময়ে তীব্র শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সে সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি। গত বছরের ১৪ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় দুই মাসে সারা দেশে ঠান্ডাজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ জনই শিশু। আর সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও রাজধানীর শিশু হাসপাতালে চলতি বছরের প্রথম ৯ দিনেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ছয় শিশু।


এ ছাড়াও শীতজনিত এই দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ লাখ ৭৬ হাজার ২১ জন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর এক বিবরণীতে এসব তথ্য জানা গেছে।


বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা বলছেন, শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন কারণে শীতজনিত রোগব্যাধিরও আগমন ঘটে। এবারও বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বা ব্রংকিওলাইটিস,  সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস ও চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এ সময় শীতের এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য ঠান্ডা অনুসারে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। বিশেষ করে শিশুদের বিষয়ে অভিভাবকদের অধিকতর সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়াও শিশুদের পুষ্টির দিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ রয়েছে তাদের।


স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৪ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ৪৯ হাজার ৫৬ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন মারা গেছেন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৬৫ জন। মারা গেছেন তিনজন।


আর বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রোগী চট্টগ্রামে। এ বিভাগে ১৪ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮ হাজার রোগী এ রোগে ভুগছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগে (মহানগর ব্যতীত) ১১ হাজার ৩৬২ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন। আর ময়মনসিংহে ৩ হাজার ৫৮২ জন, রাজশাহীতে ১ হাজার ৮৩৬ জন, রংপুরে ১ হাজার ৪৭২ জন, খুলনায় ৬ হাজার ৬১৭ জন, বরিশালে ৩ হাজার ৩২১ জন ও সিলেট বিভাগে ২ হাজার ৮৬৬ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন।


আর শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে মারা যাওয়া ৭৩ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এ বিভাগে মারা গেছেন ৪৯ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহে ২০ জন, খুলনায় দুজন ও বরিশালে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি বিভাগগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে এবারের শীত মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা নরসিংদী জেলায়। এই জেলায় ৫ হাজার ৫৫৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।


অন্যদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২২১ জন। তবে এই সময়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় কেউ মারা যাননি বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।


অন্যদিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৮ হাজার ৫২১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ১৪ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি সময়ের মধ্যে কেউ মারা যাননি। তবে চট্টগ্রাম বিভাগে এ সময়ে ডায়রিয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আর বিভাগটিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ হাজার ২৮৬ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ১২ হাজার ৬৯৪ জন, রাজশাহীতে ১৩ হাজার ১১৫ জন, রংপুরে ৮ হাজার ৪০৫ জন, খুলনায় ১৬ হাজার ৬০৫ জন, বরিশালে ১০ হাজার ৩৭৬ জন ও সিলেট বিভাগে ৬ হাজার ৯৬৩ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি টাঙ্গাইলে। এই জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫৭ হাজার ৮২১ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। যদিও কারও মৃত্যু হয়নি।


সরেজমিন রাজধানীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট এবং শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগে দেখা গেছে, শীত বাড়ায় নিউমোনিয়া ও জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি। হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকরা।


ঢামেকের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিশু ওয়ার্ডের ২০৭ ও ২০৮ নাম্বার রুমে মোট শয্যা রয়েছে ৩৮টি। কিন্তু রোগী ভর্তি আছে এর চেয়ে তিনগুণ বেশি। এর মধ্যে ঠান্ডাজনিত সর্দি-জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়ায় রোগী ভর্তি আছেন ১১ জন এবং আরেক রুমে ১৩ জন। আর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। যেখানে জরুরি বিভাগে স্বাভাবিক সময়ে রোগী আসত গড়ে ১০০-১৫০ জন। আর গত মাসে হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন ৫ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে ৬-১২ বছর বয়সি শিশু হলো ১ হাজার ৯৯১ জন। হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের মেঝেতে ও বারান্দায় পাটি, কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও তাদের স্বজনসহ অসংখ্য মানুষ-শুয়ে বসে রয়েছেন। সেখানেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা।


হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে মায়ের কোলে কান্নাকাটি করছিল আরাফাত হোসেন। তার বয়স দুই মাস। হাতে ক্যানলা লাগানো আর নাকে স্যালাইনের নল। শ্বাসকষ্ট না কমায় মুখে শিশুটিকে নেবুলাইজার দিয়ে রাখছেন তার মা রোকেয়া বেগম। 


তিনি জানান, তার বাচ্চা চার দিন ধরে এখানে ভর্তি। কিছুই খাচ্ছে না। শুধু কান্নাকাটি আর খিচুনি দিয়ে ওঠে। মেঝেতে থাকার কারণে বাচ্চাটার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।


ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আশরাফুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, শীতের সময়ে ঠান্ডাজনিত কারণে প্রতিবছরই রোগ্য-ব্যাধি বাড়ে। এবারও কিছুটা বেড়েছে। তবে খুব যে বেশি বেড়েছে তা বলা যাবে না। তবে যারা এখানে আসছে তাদের আমরা মানসম্মত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বহির্বিভাগে টিকেট কাটা থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়ার পর শয্যা পেতে, এমনকি ছাড়পত্র পেতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে রোগী ও স্বজনদের। এ ছাড়া শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে ফিরে যেতে দেখা গেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কেউ আসছেন ছয় মাসের শিশুকে নিয়ে, কেউ এসেছেন নবজাতক নিয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এসব রোগীর বেশিরভাগই ভুগছে ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে।


হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত তিন মাসে শুধু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাটিতে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৪ জন। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে ৩০৮ জন, নভেম্বরে ৩১৩ জন, ডিসেম্বরে ৪৩৭ জন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম আট দিনেই হাসপাতালটিতে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা ২২০। নিউমোনিয়া নিয়ে বর্তমানে ভর্তি আছে ২০টি শিশু। তবে সবথেকে আতঙ্কের বিষয়টি হচ্ছে বছরের প্রথম সাত দিনেই নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছয় শিশুর মৃত্যু। হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, রোগীর চাপ বাড়ায় এখানকার ৬৮০টি শয্যার একটিও বর্তমানে ফাঁকা নেই।


গত তিন দিন ধরে ঠান্ডা সঙ্গে কাশি। তবে হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জামালপুরের মেলান্দহ থেকে হালিমা আক্তার তার শিশুসন্তানকে নিয়ে আসেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। তিনি বলেন, ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ানোর পরও ঠান্ডা ভালো হয়নি। নাক দিয়ে পানি পড়ে, কাঁশিও হয়, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। বাচ্চার চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া সব হারাম হয়ে গেছে। পুরো হাসপাতালজুড়েই শুধু চিৎকার আর কান্নার শব্দ। সন্তান নিয়ে দুর্বিষহ এক সময় পার করছেন অভিভাবকরা। এমন দৃশ্য দেখা গেছে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডজুড়েই। স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকায় বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে শিশুদের।


বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে বলেন, শীতে প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ুদূষণের কারণে শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বাচ্চাদের জ্বর-সর্দি-কাঁশি হতেই পারে কিন্তু যখন দেখা যায় জ¦রের সঙ্গে বুকের ভেতরটা দেবে যাচ্ছে এবং বাচ্চার বয়স ভিত্তিক যে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি তার চেয়ে বেশি হচ্ছে- তখন কোনো ধরনের অবহেলা না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা উচিত। তিনি বলেন, শীতের সময়ে বেশি ছোট বাচ্চাকে ঘরের বাইরে বের না করাই ভালো। আর এই সময়ে শিশুদের প্রচুর তরল ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার এবং শাকসবজি বেশি করে খাওয়ানোর পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।


প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, শীতে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বাতাসে ভাইরাসসহ ধূলি-বালি বেশি ছড়ায়। ফলে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানির কারণে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায়, ফলে শ্বাস নিতে সমস্যা বেশি হয়। এ ছাড়াও ব্রংকিওলাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া ও ত্বকে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ বেশিমাত্রায় দেখা যায়।


শীতের এই সময়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ঠান্ডাজনিত রোগগুলো যেন না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজন মতো গরম কাপড় পরা, তীব্র শীতের সময় কান-ঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করতে হবে এবং ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। আর শিশুদের অনেক সময় বেশি কাপড় গায়ে থাকলে তারা ঘেমে যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।