মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা

মূল্যবৃদ্ধির চাপে দেশের সাধারণ মানুষ

প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:২২ | অনলাইন সংস্করণ

  অনলাইন সংস্করণ

মূল্যবৃদ্ধির চাপ আর নিতে পারছে না দেশের সাধারণ মানুষ। এর ওপর বিদ্যুতের আবার মূল্যবৃদ্ধি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মহামারি করোনা শুরুর পর থেকে টানা তিন বছর ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কষ্ট এখনও শেষ হয়নি। খাদ্যপণ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্য-উভয়েরই দাম বেড়েছে লাগাম ছাড়া। এর মধ্যে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম, জ্বালানি তেলের দাম। বেড়েছে পরিবহন ভাড়া ও পানির দাম। শিক্ষা ব্যয় ও সব ধরনের ওষুধেরও দাম বেড়েছে অনেকখানি। পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কিছুরই দাম বেড়েছে। এত দাম বৃদ্ধির মধ্যেই সরকার আবারও দাম বাড়াল বিদ্যুতের। ফলে মূল্যবৃদ্ধির চাপে একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা দশা দেশের সাধারণ মানুষের।

বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির চাপ সইবার মতো অবস্থা দেশের মানুষের আর নেই। এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে অন্য কোনোভাবে সমন্বয় করা দরকার ছিল বলে মত তাদের। 

এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মানুষের এখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে। সাধারণ মানুষ তিন বেলার আহার জোটাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় কাটছাঁট করে কোনো রকমে টিকে আছে। এ অবস্থার মধ্যে গত বছর কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম। আসলে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার- সেসব ধরনের পণ্যের দামই বেড়েছে অস্বাভাবিক। মূল্য বৃদ্ধির চাপে অনেক আগেই দেশের সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এখন দেয়াল ভেঙে তাতে চাপা পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মোটেই ঠিক হয়নি।

ভোগ্যপণ্যের বাজারে চাল, আটা-ময়দার মতো প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম এখন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এক কেজি চিকন চালের কেজি এখন ৮০ টাকারও ওপরে, আর মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এক বছর আগেও যেখানে এক কেজি খোলা আটার কেজি ছিল ৩২-৩৫ টাকা, এখন তার দাম ৬০ টাকার ওপরে। এক কেজি ময়দার দাম এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এর বাইরে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম-সব ধরনের পণ্যের দামই আকাশ ছোঁয়া। এর পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাবান, পাউডার, টুথপেস্টের মতো পণ্যের দাম এর আগে কখনো এতটা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়নি। এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হারও এখন ৮ শতাংশের কাছে।

খাদ্যপণ্যের বাইরে গত বছরের জুনে দেশে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২২.৭৮ শতাংশ। দুই চুলার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার গ্যাসের দাম ৯৯০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রিপেইড মিটারের বাড়ানো হয়েছে ৪৩ শতাংশ। গত বছরের আগস্টে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এক লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১১৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩০ টাকা। এর পর গত বছরের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম পাইকারিতে বাড়ানো হয় ১৯.৯২ শতাংশ। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়নো হলো ৫ শতাংশ বা ইউনিট প্রতি গড়ে ৩৬ পয়সা।

এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছরের আগস্টে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ২২ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর মধ্যে চলাচল করা বাসের ভাড়া বাড়ানো হয় ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। ঢাকার আশপাশের এলাকায় চলাচল করা বাসের ক্ষেত্রে তা ১৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ফলে দেশের মানুষের যাতায়াত ব্যয়ও বেড়েছে।

এর পর নতুন বছরে এসে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির চাপ। এই জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়েছে নিম্নে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর পাশাপাশি শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ, সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, মানুষের আরেক মৌলিক চাহিদা পোশাক-পরিচ্ছদেরও দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে-মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তার সবগুলোর দামই বেড়েছে আকাশ ছোঁয়া। আর এই মূল্য বৃদ্ধির চাপে দেশের মানুষ এখন এক রকম চিড়েচ্যাপ্টা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এক দিকে মানুষের আয় কমেছে, অন্য দিকে পণ্য ও সেবা মূল্য বেড়েছে লাগামহীন। এতে করে মধ্যবিত্তরা দিনকে দিন গরিব হচ্ছে, গরিব গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দুস্থ-অসহায় মানুষের কাতারে। করোনার পর থেকে যে সংকটে পড়েছিল দেশের মানুষ, সরকার সে সংকট দূর করতে তো পারেই নি, উল্টো সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের কষ্টও আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ আর মূল্য বৃদ্ধির চাপ সহ্য করতে পারছে না। সরকারের উচিত দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হয় এমন কিছু জনমুখী পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষ করে সবার আগে পণ্যমূল্য কীভাবে কমানো যায় সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।