কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুই টিউবের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। চলছে গাড়ি চলাচলের প্রস্তুতি। তবুও বলা হচ্ছে প্রকল্প কাজের ৪.৫ শতাংশ বাকি। যা চলতি জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সম্পন্ন হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, কাজ শেষের দিকেও এই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব যাচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। যা আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় একনেক সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটির ব্যয় আরও ৩ শতাংশ (৩১৬ কোটি টাকা) বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার সংশোধন করা এই প্রস্তাব অনুমোদন পেলে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াবে ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। আর প্রকল্প মেয়াদ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে প্রশ্ন উঠেছে, চলতি জানুয়ারি মাসে টানেলে গাড়ি চলাচল শুরু হবে বলে যে কথা বলা হয়েছে সেটি কি ফাঁকিঝুঁকি? প্রকৃতপক্ষে এই টানেলে গাড়ি চলাচল শুরু হবে কবে? এ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক একেক সময় একেক কথা বলছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুন উর রশিদ চৌধুরী বলেন, জানুয়ারি মাসে গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কখনো বলা হয়নি টানেলে গাড়ি চলাচল জানুয়ারি মাসেই শুরু হবে। এটা ফেব্রুয়ারি মাসেও হতে পারে। আপনি আবার এটা লিখে দিয়েন না, টানেলে গাড়ি চলাচল জানুয়ারি মাসে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, গাড়ি চলাচল শুরুর বিষয়টি মূলত নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আমরা প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করবে কখন, কোনোদিন টানেলে গাড়ি চলাচল শুরু করবে। বিষয়টি এখনও মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ চৌধুরী বলেন, এবার মূলত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই প্রকল্পের ব্যয় ৩ শতাংশ বাড়ছে। ডলারের দাম না বাড়লে এই সংশোধনের প্রয়োজন হতো না। ২০১৫ সালে এই প্রকল্প গ্রহণের সময় টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ১ ডলারে ৮২ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর এক বছরে এই হার ১০৫ টাকার ওপরে চলে গেছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর একনেক সভায় চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দুই পারে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে তুলতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর।
চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (সিসিসি) নির্মাণকাজ শুরু করে। তখন ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বরের একনেক সভায় প্রায় ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ব্যয় এবং বাস্তবায়ন সময় ১ বছর ৬ মাস বাড়িয়ে প্রথমবার প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। তখন প্রকল্পটি ২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্য ধরা হলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরকার বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১ বছর বাড়ানোর সুযোগ দেয়। সে হিসাবে প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর মাসে শেষ করার কথা ছিল।
গত ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের একটি টিউব উদ্বোধন করেন। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ১৫ জানুয়ারির পরে পুরো প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে। তবে শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এই টানেল এপ্রিলের শেষে বা মে মাসের শুরুতে উন্মুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার অনুমতি চাইলে প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। সেখানে ওয়ার্কার ছাড়া আর কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। অতএব, প্রকল্পের ভেতরে পরিদর্শন করার কোনো সুযোগ নেই।
এখনও চলমান সার্ভিস এরিয়ার কাজ : প্রায় ৯৫ একর জায়গাজুড়ে আনোয়ারা প্রান্তে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সার্ভিস এরিয়ার কাজ। এতে একটি করে টানেলের র্যাপলিকা, কনভেনশন সেন্টার, হেলথ সেন্টার, হেলিপ্যাড, মসজিদ, টানেলসহ চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর, ভিভিআইপি বাংলো এবং ৩০টি রেস্ট হাউস গড়ে তোলা হচ্ছে। এ সার্ভিস এরিয়াতেই গড়ে তোলা হচ্ছে টানেলের দক্ষিণ অংশের একটি পুলিশ থানা। সার্ভিস এরিয়াটির বাইরে দিকে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, আনোয়ারা এলাকার টানেলের দক্ষিণে মূলত পারকি খালের উত্তরে নির্মিত হচ্ছে এ সার্ভিস এরিয়া। বেশ তোড়জোড় নিয়ে চলছে সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ। এ নির্মাণকাজে থাকা ভবনগুলো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। পারকি খালেও নির্মাণ করা হয়েছে একটি কালভার্ট। এর দক্ষিণে রাখা হয়েছে তিনটি রেস্ট হাউস। পুরো এলাকা নিরাপত্তা বেষ্টনীর দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
এ সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে কত সময় লাগবে জানতে চেয়ে কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের সার্ভিস এরিয়ার কাজ এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এখন আমরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করে পাবলিকের জন্য ছেড়ে দিতে চাচ্ছি। টানেলের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। টানেল উন্মুক্ত করলেও সার্ভিস এরিয়া আপাতত উন্মুক্ত করা হবে না। আমরা নির্ধারিত সময়ে এটি উন্মুক্ত করে দিলে পাবলিক নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়ে সেখানে থাকতে বা অনুষ্ঠান করতে পারবে। তবে শেষ পর্যায়ের কাজ কোনোভাবে যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা ওখানে আপতত কাউকে এলাউ করছি না।
তিনি বলেন, টানেলের কারণে আনোয়ারার অনেক পরিবর্তন হবে। কিন্তু উন্নয়ন অনুপাতে সেখানে তেমন কোনো ভালো হোটেল বা রিসোর্ট নেই। এ পরিকল্পনা থেকেই এ সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে আনোয়ারায় অংশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভালো প্রভাব পড়বে। এ সার্ভিস এরিয়া প্রায় ৯৫ একর জায়গাজুড়ে হচ্ছে। এখানে ভিভিআইপি বাংলো করা হচ্ছে। এ সার্ভিস এরিয়ার ব্যয় টানেলের প্রকল্প ব্যয়ের ভেতরেই রয়েছে। এ ছাড়া টানেলের প্রকল্পে আগে না থাকলেও পরবর্তীতে স্ক্যানিং মেশিন বসানোর পরিকল্পনা হয়েছে। স্ক্যানিং মেশিন অল্প কিছুদিনের মধ্যে বসানো হবে।