ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এই প্রথম নির্বাহী আদেশের প্রয়োগ

বিইআরসি ঠুঁটো জগন্নাথ

বিইআরসি ঠুঁটো জগন্নাথ

দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও এলপিজির দাম নির্ধারণ করত শুধু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ সরকার যেন ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ ও সমন্বয় করতে পারে সেজন্য গত ১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটিকে এখন আইনে পরিণত করার প্রক্রিয়া চলছে। এ অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলেই বৃহস্পতিবার বিইআরসিকে ‘উপেক্ষা’ করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়। ফলে বিইআরসি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হলো, জবাবদিহিতার জায়গা থাকল না বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি করেছে, ৩০ জানুয়ারির মধ্যেই আদেশ দেওয়া হবে জানিয়েছে। তারপরও কমিশনকে উপেক্ষা করে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট। বিইআরসির ওপর অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করা হলো, ক্ষমতা খর্ব করা হলো। ফলে কমিশন অকার্যকর হয়ে গেল- এটি বাস্তবতা। জ্বালানি খাতে অপব্যবহার, অপচয় ও দুর্নীতির বিষয়ে জবাবদিহিতার পথে বাধা সৃষ্টি হলো। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহিতা কমে যাবে। ইচ্ছামতো দাম বাড়াতেই এটি করা হয়েছে। জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। কমিশন শুধু গ্যাস, বিদ্যুৎ ও এলপিজির দাম নির্ধারণ করত। কমিশনের এখতিয়ারে হলেও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করত সরকার নিজেই। এ ছাড়া বিইআরসির কাছ থেকে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি এলপিজির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করত সরকার নিজেই। অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যখন খুশি তখন তেল ও গ্যাসের দামও বাড়াতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় চেয়েছিল বিইআরসিই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিক। তবে তা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু বিইআরসি চেয়েছিল ৩০ জানুয়ারির মধ্যে আদেশ দিতে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি মন্ত্রণালয়। এ জন্য তাদের পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, বিইআরসি গণশুনানি করেছে। পরবর্তী পদক্ষেপও তাদের নেওয়ার কথা। তা না করে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার বিইআরসির কর্তৃত্ব খর্ব করেছে, এটি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে হয়ে গেল। বিইআরসির ওপর অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করা হলো। এটি অগ্রহণযোগ্য।

তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সব কমিশনের ওপরই একধরনে সরকারি, আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাব একটা বাস্তবতা। এটি সেই দৃষ্টান্ত।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকারের যে এখতিয়ার রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তার অপব্যবহার করা হয়েছে। অধ্যাদেশ ঢালাওভাবে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করা গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে বিইআরসির এখতিয়ার পদদলিত করা হয়েছে। জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি খাত, সেই খাতে জনগণের নামমাত্র অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিশন গণশুনানি করত, সেটিকে পদদলিত করা হলো।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অকার্যকর হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ভোক্তার জ্বালানি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার আইনি সুযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা রাষ্ট্র কেড়ে নিল। সেই সুযোগ অকার্যকর হয়ে গেল, বিইআরসিও অকার্যকর হয়ে গেল।

নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, সব দেশের সব সরকারেরই নিজের আইন ভঙ্গ করার একটা প্রবণতা থাকে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। এ সংস্কারের মধ্যেই ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাজ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রচ- চাপেই ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। এখন যা করা হচ্ছে, এটি পরিষ্কারভাবে পেছনের দিকে যাওয়া। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে। ইচ্ছামতো দাম বাড়াতেই এটি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু বিশেষ সময়ে দাম নির্ধারণ করবে সরকার। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতির কোনো ব্যাখ্যা নেই। সরকার যেটাকে বিশেষ পরিস্থিতি বলবে, সেটাই বিশেষ পরিস্থিতি হয়ে যাবে। ওইটা আসলেই বিশেষ পরিস্থিতি কি না, তা যাচাই করার তো সুযোগ নেই। এতে সরকার যখন খুশি তখন দাম বাড়াতে পারবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর ফলে ‘বিইআরসি কার্যত ডেড’ হয়ে গেল। এটি দুঃখজনক। থাকলেও কোনো কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা শুরু এর পর থেকে নির্বাহী আদেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামও বাড়ানোর পথ সুগম হলো।

তিনি বলেন, বিইআরসির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে আগামী ১ বছরের মধ্যে দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকত না। নির্বাহী আদেশ প্রয়োগ শুরু হওয়ায় সেই সুযোগ তৈরি হলো। এ ছাড়া জ্বালানি খাতে অপচয়-অপব্যবহারের কোনো প্রশ্ন ছাড়াই জনগণের ঘাড়ে পড়বে।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, বিইআরসির কার্যক্রমেই আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। তারপরও জনগণের কথা বলার একটা জায়গা ছিল। সেটিা আর থাকল না। কাগজে কলমে থাকলেও কার্যকারিতা বাস্তবে দেখা যাবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানি ও তেলের দাম কমে যাচ্ছে সেখানে নির্বাহী আদেশে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। জনগের কোনো ভূমিকাই থাকল না। জ্বালানি খাতের দুর্নীতি অব্যবস্থাপনার মাসুল দিতে হবে জনগণকে।

প্রসঙ্গত, প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার সরকারের নির্বাহী আদেশে দেশে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এতে ইউনিটপ্রতি ৩৬ পয়সা বেড়ে দাম দাঁড়াবে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা।

বিইআরসি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত