ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ

বৈশ্বিক ক্ষমতার মেরুকরণের এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। দুটি রাষ্ট্রই বাকিদের নিজেদের দলে টানার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যোগ দিতে বাংলাদেশ যে স্বপ্ন বুনেছে তা বাস্তবায়নে পশ্চিম ও পূর্বের এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গেই শত্রুতা নয়- এই পররাষ্ট্র নীতির আওতায় বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই থাকতে চায়। সে সঙ্গে উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো অর্থনৈতিক জোটে বাংলাদেশ যোগ দিতে সম্মত আছে, তবে কোনো প্রকার সামরিক জোটে যোগ দিতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন, বৈশ্বিক ক্ষমতাধর এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিবাদের অংশ হয়ে চায় না, বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই দুই পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ। চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং চলতি সপ্তাহের এমন এক সময়ে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা এবং হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চারদিনের বাংলাদেশ সফরে ছিলেন। বৈশ্বিক মেরুকরণের চলমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন দুই দেশই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ঘনিষ্ঠভাবে পাশে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায় যে তাদের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশে যোগ দিক। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-খ- ব্যবহার করতে চায়। ঠিক তেমনিভাবে চীন চায় যে তাদের নেতৃত্বে বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জিএসআই) এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ যোগ দিক। এই ইস্যুতে দুপক্ষই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ দুপক্ষকেই জানিয়েছে যে ঢাকা এসব ইস্যু পর্যালোচনা করে দেখছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এই সময়ে চীন-রাশিয়া একাট্টা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যে সব রাষ্ট্রই তার পক্ষে থাকুক। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেকটা কমে গিয়েছিল কিন্তু এটা আবার খানিকটা বেড়েছে এই কারণে যে চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূ-খ- ব্যবহার করতে পারলে অনেকটা সুবিধা পাবে। এই অঞ্চলে মিয়ানমার-চীন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশেরও সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যে তাদের যেসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে, সেখানে যেন বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে থাকে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হলে দেশের রফতানি পণ্যে আঘাত আসবে, অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ওয়াশিংটন কথা বলবে, আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। আবার চীন অসন্তুষ্ট হলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব পড়বে। তৈরি পোশাকের অধিকাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে, সেখানে প্রভাব পড়বে। তাই আমাদের সবার সঙ্গেই থাকতে হবে। সামনে আরও অনেক চাপ আসবে কিন্তু আমাদের কৌশলী হতে হবে।

কূটনীতিকরা আরও বলছেন, ঢাকার ভারসাম্য রক্ষার পলিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ রয়েছে। যা প্রকাশ পেয়েছে গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এলিট বাহিনী র‌্যাব এবং সংস্থাটির (ওই সময়ের সাবেক ও বর্তমান) ৭ সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু গণতন্ত্র, ভোট ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে এত সোচ্চার হওয়ার পেছনে যুক্তি দেখাচ্ছে যে বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে বিশ্বব্যাপী ধরে রাখতে চায়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরাইলসহ একাধিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঠিক চর্চা হয় না, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র নীরব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সোচ্চার হওয়ার নেপথ্যে কাজ করছে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা বা চীনকে মোকাবিলার কৌশল হিসেবে। এই অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূ-খ- ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলাসহ বিভিন্নভাবে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প থমকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কেননা বেইজিং ঢাকার একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে।

দেশের রফতানি বাজারের মূল গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত বাণিজ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত অক্টোবরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি করেছে ৪০ হাজার ১৭ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য, বিপরীতে ওই দেশ থেকে আমদানি করেছে ২ হাজার ২৪৯ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য।

অন্যদিকে একই সময়ে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫১ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য, বিপরীতে দেশটিতে রফতানি হয়েছে ৬ হাজার ১৮১ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য।

গত বছরের অক্টোবর মাসের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রফতানি ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং আমদানি হয় প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে চীনের দিকে বাণিজ্য পাল্লা বেশি পরিমাণে ঝুঁকে আছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৮০ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য চীনে রফতানি করেছে। এর বিপরীতে চীন থেকে আমদানি করেছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এই সপ্তাহের সোমবার মধ্যরাতে বলেন, ‘দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যে সমতা ফেরাতে চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার কথা ছিল। যা গত বছর ঘোষণা দিয়েছিল চীন। কিন্তু গেজেট না হওয়ায় দীর্ঘদিন পার হলেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে গেজেট নোটিফিকেশন ঘোষণা দিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।’

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন যে মূলত ৫টি লক্ষ্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবায়ন করতে চায়।

রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘লক্ষ্য নম্বর এক, আরও বেশি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ, নিজেদের নিরাপত্তায় আরও বেশি সক্ষম, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি হুমকি মোকাবিলা করতে পারে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায় ক্রমবর্ধমানভাবে অবদান রাখতে পারে। লক্ষ্য নম্বর দুই, বাংলাদেশ গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ, সহনশীলতা/পরমতসহিষ্ণুতা, সুশাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লক্ষ্য নম্বর তিন, বাংলাদেশ সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে সহিষ্ণু একটি দেশ। লক্ষ্য নম্বর চার, টেকসই ও বিস্তৃত পরিসরের সমৃদ্ধি এবং শ্রমমানের উন্নতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করবে এবং বাংলাদেশকে বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সংযোগ গড়ে তোলার জন্য উন্মুক্ত করবে। লক্ষ্য নম্বর পাঁচ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সুরক্ষায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করছে এবং তাদের বার্মায় নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখবে।’

অন্যদিকে গত ২ জুন চীন বাংলাদেশকে জানায় যে, ‘চীন বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধের মানসিকতা এবং ব্লক রাজনীতিতে যোগ দেবে না। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে পশ্চিমাদের যুদ্ধ এবং ব্লক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবে।’

এর আগে, ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় নিযুক্ত ওই সময়ের চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কোয়াডে (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত এই চার দেশের সামরিক জোট) অংশ নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে চলছে ও এর উন্নয়ন অভাবনীয় এবং চীন এর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চায়। চীনের মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জোগান ব্যাহত হচ্ছে, আর্থিক লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে এবং নতুন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

বিগত ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ে দুপক্ষের মধ্যে কৌশলগত চুক্তি হয়। ওই সময়ে চীন বাংলাদেশের পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত ২৭ প্রকল্প উন্নয়নে ২৪০০ কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুত ২৭ প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত চীনের সঙ্গে ৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণচুক্তি সই হয়েছে এবং চীন ছাড় করেছে ৩৩০ কোটি ডলার। ৮টি প্রকল্প হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য ছয়টি জাহাজ কেনা, দাসেরকান্দিতে পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প, মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন ও মুরিং স্থাপন, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় ধাপের উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন। এ ছাড়া তিস্তা অববাহিকা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে, যা নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কথা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় অর্থ সহায়তার বেশ কিছু চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু সব এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ছাড়ের অনুরোধ করেছি।’

বাংলাদেশের অন্যতম সংকট ও বোঝা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েই সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, ‘বার্মা থেকে বাংলাদেশে ও এ অঞ্চলে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী, বার্মায় চলমান সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের জন্য ১৯০ কোটি ডলারেরও বেশি মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে।’ এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সময়ে সময়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের একাধিক প্রতিনিধির ওপর নিষেধ্বাজ্ঞা জারি করেছে। মিয়ানমার রাখাইনে যে গণহত্যা ঘটিয়েছে তার স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যদিকে এই সংকট সমাধানে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে। গত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্ষমতা দখল করলে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ছেদ পড়েছিল। পুনরায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চালু করতে চীন ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ গত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে মর্টার ও গোলা ছুড়লে, চীনের মধ্যস্ততায় সমাধান আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এই প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের বড় ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গা এবং এই বিষয়ে চীনারা আমাদের সহায়তা করছে। সেই সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে চীনের মন্ত্রী অঙ্গীকার করেছেন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারে কিছু অসুবিধা আছে। সেজন্য এটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

এক সময়ে বাংলাদেশের অস্ত্র সংগ্রহের মূল গন্তব্য ছিল চীন। মূলত স্বল্পমূল্যে চীনের অস্ত্র পাওয়া যেত এই কারণেই একটা সময়ে দেশের অস্ত্র সংগ্রহের কমবেশি ৮০ শতাংশই ছিল চীনের তৈরি। বিগত ২০১৬ সালের নভেম্বরে চীনের তৈরি দুটি সাবমেরিন দেশের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। ২০০৯ সালে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন বা ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। যার আওতায় একক নয়, বহুমুখী উৎস থেকে বাংলাদেশ অস্ত্র সংগ্রহে সিদ্ধান্ত নেয়। আধুনিক এবং উন্নত মানের অস্ত্র বাংলাদেশের কাছে বেচতে কমবেশি ৫ বছর ধরে চুক্তি করার আহ্বান জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যদিকে ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়ন এবং সমরাস্ত্রের বহুমুখী উৎস নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেরও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার আগ্রহ রয়েছে। গত বছরের ৩ থেকে ৭ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে পররাষ্ট্র সচিবসহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন সফর করেন। ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, একাধিক কংগ্রেসম্যান এবং বাইডেন প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের মধ্যে অন্যতম ইস্যু ছিল বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বেচা-সংক্রান্ত শর্ত ও আইন নিয়ে পর্যালোচনা। অস্ত্র সংগ্রহ-সংক্রান্ত মূল বৈঠকটি হয় গত বছরের ৬ এপ্রিল অষ্টম নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠানে। ওই সংলাপে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

অন্যদিকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি বনি জেনকিন্স যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপে নেতৃত্ব দেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ওই সংলাপে অস্ত্র সংগ্রহ করা সংক্রান্ত ইস্যুতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সফল আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কমমূল্যে এবং অস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা দেবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার পূর্বশর্ত হচ্ছে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসমিয়া) এবং দ্য অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) সই করা। আকসা হচ্ছে সামরিক রসদবিষয়ক কেনাকাটা করার একটি রূপরেখা চুক্তি। জিসমিয়া হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সামরিক খাতের গোপন তথ্য বিনিময়।

এর আগে গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী র‌্যান্ডল শ্রাইভার ঢাকা সফরে এসে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আকসা এবং জিসমিয়া চুক্তি করা গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আকসা চুক্তি সই করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে একই বছর ভারতের সঙ্গে জিসমিয়া চুক্তি সই করে দেশটি। চলমান ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করায় এই দুটি চুক্তিতে ঢাকা রাজি হলে দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্র খুব শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যাবে।

ওয়াশিংটনে নিরাপত্তা সংলাপ শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা সফল হয়েছে। আশা করি, আগামী বছরের মধ্যে (চলমান এই বছর) জিসমিয়া চূড়ান্ত করা যাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক পরিকল্পনার অংশ হয়ে উঠছে। পররাষ্ট্রনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা হওয়া উচিত। নইলে বিষয়টি যখন আরও পরিণত হবে তখন জনগণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়াতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সবসময় শর্তযুক্ত। অনেক দেশ এরপরও কেনে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে। খুশি করার প্রয়োজন যদি হয়!’ বাংলাদেশের এই ক্ষেত্রে কী করা উচিত, জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের স্বার্থে সবার সঙ্গেই থাকতে চাই, তবে এটা চ্যালেঞ্জিং। তাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ থাকতে পারে কিন্তু সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমরা আমাদের জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে চাই। এ জন্য আমরা যে কোনো অর্থনৈতিক ফোরামে যুক্ত হতে রাজি আছি। কিন্তু কোনো প্রকার সামরিক জোটে যেতে আগ্রহী নই।’

চীন
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত