জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন সরাসরি উপলদ্ধি করছে বিশ্ব। বাংলাদেশেও পড়েছে এর প্রভাব। ভরা বর্ষাতেও যেমন কমছে বৃষ্টিপাত, তেমনি তীব্র শীতের মৌসুমেও গরমে হাঁসফাঁস করছে দেশের অনেক অঞ্চলের মানুষ। বাংলাদেশে সাধারণত ইংরেজি ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শীতের তীব্রতা থাকে। বাংলা অগ্রহায়ন, পৌষ ও মাঘ মাসের মধ্যে পড়ে।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। কিন্তু এবার মাঘ আসার আগেই যেন বিদায় নিয়েছে শীত। মাঘ মাসের শুরুর দু’একদিন শীতের তীব্রতা থাকলেও সপ্তাহ না যেতেই বিদায় নিয়েছে শীত। মাঘের ১০ তারিখেই (২৪ জানুয়ারি) রাজধানীর অনেক বাসা ও অফিসে এসি ফ্যান চলতে দেখা গেছে।
গত ৫ ডিসেম্বর চলতি মৌসুমে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। একই দিনে ২৫ জেলার উপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। জেলাগুলো হলো- ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, ফেনী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, বরিশাল ও ভোলা জেলা ও পুরো রংপুর বিভাগ। তার সপ্তাহ না পেরুতেই পাল্টে যায় পুরো দেশের চিত্র। শীত বিদায় নিয়েছে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে। শুধু উত্তরের দু-একটি জেলায় রয়েছে কিছুটা শীতের তীব্রতা। শুধু শীতই নয়। কমেছে বৃষ্টিপাতও। অপরদিকে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত কয়েক মাসে আবহাওয়ার রিপোর্ট স্বাভাবিক ছিল না। আবহাওয়া অফিসের গত মাসের পর্যলোচনা ও আগামী তিন মাসের পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে সার্বিকভাবে সারাদেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম (৬৬.৬%) বৃষ্টিপাত হয়েছে।
৫ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় দক্ষিণ আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। এটি ১০ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর তামিলনাড়ু উপকূল অতিক্রম করে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপ এবং সন্ধ্যা ৬টায় নিম্নচাপ আকারে তামিলনাড়ু ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করে।
তার কিছুদিন আগে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে একটি ঘূর্ণিঝড় সরাসরি আঘাত হানে। গত বছরের ২৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূল হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা অতিক্রম করে। এর প্রভাবে বিভিন্ন জেলায় ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আশ্রয়েকেন্দ্রে আশ্রয় নেয় প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। এ নিয়ে তারা বিস্তর গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৮টি দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিরূপ পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলে ইতোমধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্ব্যব্যাপী বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাখ লাখ লোক পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তারা অবশ্য এ কথাও বলে আশ্বস্ত করেছেন, উন্নত পরিবেশ, দূষণরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব হতে পারে।
ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ৬০ জনের একটি আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকার এ জরিপ কার্যক্রম চালায়। জরিপে বলা হয়েছে, উপকূলের ব্যাপক এলাকা সাগরের স্ফীত পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হবে। মিষ্টি পানির প্রবাহে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। উপকূলীয় ব্যাপক এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপও বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ৮টি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে এই দেশগুলো।
বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রিন হাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ার কোনো প্রবণতা নেই বলে গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় দেশের তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা কর হচ্ছে। যেটার মূলে রয়েছে ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’।
এর জন্য বন উজাড়কেই প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশকে সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারি হিসাব মতে শতকরা ৯ ভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বনভূমির পরিমাণ ৬ ভাগের বেশি হবে না বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দেশে বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, মূলত বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এমন ঘটনা ঘটছে। বর্ষাকালে ঠিকমতো বৃষ্টি হচ্ছে না। শীতকালে শীত বেশিদিন থাকছে না। আগে তিন মাসের কাছাকাছি শীত থাকত। নভেম্বর ডিসেম্বর জানুয়ারি। যা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেখা যেত। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন এখন জানুয়ারির মাঝামাঝি বা শেষের দিকে এসে গরমই পড়ছে বলা যায়। কয়েকদিন ধরে মানুষ হাফ শার্ট পরে ঘুরাঘুরি করছে। তেমনিভাবে বর্ষার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। কয়েকদিন অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়। আর বাকি সময় বৃষ্টি হয় না। কিন্তু শীত ও বর্ষার ডিউরেশন কমে গেলেও গ্রীষ্ককালের ডিউরেশন বেড়েছে। একটা লম্বা সময় তীব্র তাপপ্রবাহ থাকছে। আগে এই তাপদাহ কম সময় থাকত। বছরে হয়তো ৩-৪ দিন। কিন্তু এখন সেটা কয়েক দফা লম্বা সময় নিয়ে থাকে। বিশেষ করে নগর অঞ্চলে এর প্রবণতা বেশি। আবার নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুযোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো সবই আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের রূপ বলা যায়। তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টা আসলে দু-এক বছরে বোঝা যায় না। এটা ৩০ বছরের একটা স্লট। ধরেন ১৯০০ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত একটা স্লট। আবার ১৯৬০-১৯৯০ সাল একটা স্লট। তেমনি ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল একটি স্লট। এটা আপনাকে সেভাবে হিসেব করতে হবে যে ৩০ বছর আগে আবহাওয়ার ধরন কি ছিল এবং বার্তমানে তা কিরকম হয়েছে। এভাবে তুলনা করা হয়। ৩০ বছর আগের আবহাওয়া বা তার আগের আবহাওয়ার সাথে মেলালে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।