কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি, মেধায় নিয়োগ ৯৩%

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৪, ১৯:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পর মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, বাকি ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। আপিল বিভাগের সেই রায়ের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এর আগেও শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন দেয়। 
গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সব গ্রেডে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত কোটায় যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদগুলো সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হবে। কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত আগের সব পরিপত্র-প্রজ্ঞাপন-আদেশ-নির্দেশ-অনুশাসন বাতিল করা হয়েছে।

সরকারি সব চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারির পর গুলশানে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফলে আপিল বিভাগের দায় প্রতিপালন করেই কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়েছে। 
তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে যেসব সহিংসতা হয়েছে এর জন্য বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন কমিটির সদস্যরা।
আন্দোলনকারী আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার দায়ভার সরকার নেবে এমন আশ্বাস দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, কোটা আন্দোলনে যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার দেখভাল করবে। যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী কোটাবিরোধী আন্দোলন করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে সেগুলো আমরা দেখব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সব ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে সরকার।

শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার আহŸান জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কার চেয়েছিল, সরকার সেটি করেছে। এখন জনগণের চাওয়া শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব জায়গায় ফিরে গিয়ে লেখাপড়া শুরু করুক।
কোটা সংস্কার নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি হলো। গত সোমবার রাতে প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি গণমাধ্যমের সামনে পাঠ করেন। এ সময় তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ৫ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ রেখে প্রজ্ঞাপন জারি হলো। এ সময় তিনি আপিল বিভাগের এই রায়কে ঐতিহাসিক এবং সুদূরপ্রসারি বলেন। প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। এই সময় আইনমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের এই রায় মেনে ক্লাসে ফেরার আহŸান জানান। 
নারী ও জেলা কোটা না থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারীরাই বলেছেনÑ তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন, তার কারণ হচ্ছেÑ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী। অনেক কিছুই এখন নারীরা পারছেন। আনিসুল হক বলেন, আমি বলেছিলাম গতকাল মঙ্গলবারের মধ্যে কোটা রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি হবে। সরকার গতকাল মঙ্গলবার আপিল বিভাগের এই ঐতিহাসিক রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি করল। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবির সমাধান হয়েছে।

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের চলমান প্রেক্ষাপটের বেশকিছু পদক্ষেপ উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন। কোটা বাতিলের পর বীর মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজন সন্তান হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন, সেই রিট পিটিশন শুনানি হওয়ার পরে হাইকোর্ট বিভাগের একটি দৈত্বব্যাঞ্চ একটা রায় দেয়, সেই রায়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন এবং বাতিল করে দেন। রায় বাতিল করে পুনর্বহাল করা হলে সেটার বিপক্ষে তিন দিনের মধ্যে আপিল বিভাগে আপিল করে সরকার। কারণ সরকার কোটা বাতিলের পক্ষে ছিল। কোটা বাতিল চেয়ে যখন সরকার আপিল করে. তখনও কোটা আন্দোলনকারীদের কেউ পক্ষভুক্ত হয়নি। সেই ক্ষেত্রে চেম্বার জর্জ আপিল বিভাগের ফুল ব্যাঞ্চে পাঠানো হয়। তখন আপিল বিভাগ একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেন। কোটা আন্দোলনকারীরা আপিল শুনানির আগে পক্ষভুক্ত হন। পক্ষভুক্ত দরখাস্তের ওপরে যখন শুনানি হয়, তখন আপিল বিভাগ একটা আদেশ দেন। সেই আদেশে আপিল বিভাগ পরিষ্কারভাবে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় বাতিল করেছে, সেটা অকার্যকর থাকবে। যতদিন পর্যন্ত আপিল বিভাগে শুনানি না হবে। এরপরও কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছিল, অন্যদিকে কিছু মহল এই আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে অবলম্বন করে। একপর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেনÑ আন্দোলনের পাশাপাশি তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশে আমি নিজেই বলেছিলামÑ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসতে চাইলে সরকার রাজি আছে। পরে আমরা কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম। ওই আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করে বলেছিলামÑ কোটার বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটার সুষ্ঠু সমাধানে আসা সম্ভব। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের মামলাটি আপিল বিভাগে রয়েছে, সেই মামলাটি আগস্টের ৭ তারিখে শুনানি হওয়ার কথা ছিল, যা আমরা এগিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা করব। সেই দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল কোটা পদ্ধতি সংস্কার মামলাটি এগিয়ে এনে জুলাইয়ের ২১ তারিখে নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। পরে কোটা সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত রায় দেন। আপিল বিভাগ বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে কোটার ব্যাপারে একটা নির্দেশনাও দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী- কোটা পদ্ধতিতে মেধায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের ১ শতাংশ এবং নৃ-গোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নতুন নয়, ১৯৭২ সাল থেকেই বিভিন্ন হারে কোটা চলে আসছে। সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড রয়েছে। সরকারি ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করা হয়। তবে ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডের (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) কোটা ছিল। তবে সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজন সন্তানদের আবেদনে হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করেন। তবে গত রোববার কোটা পদ্ধতির ভিত্তিতে সরকারি চাকরি নিয়োগের হাইকোর্টের দেওয়া সেই রায় বাতিল করে মেধাভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ কোটা রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ।