স্টপেজে থামছে বাস, যাত্রীরাও বসছেন ছাউনিতে

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর শিক্ষার্থীরা

বেঁকে বসেছে ট্রাফিক পুলিশ

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১৮:২০ | অনলাইন সংস্করণ

  ফারুক আলম

এতোদিন ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ট্রাফিক পুলিশ। বিভিন্ন দাবিতে কয়েক দিন ধরে বেঁকে বসেছেন তারা, কর্মবিরতিও দিয়েছেন। এতে ভেঙেপড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার হাল ধরেন শিক্ষার্থী, ফায়ার সার্ভিস ও আনসার সদস্যরা। তবে গতকাল কিছু জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ ফিরলেও বেশিরভাগ সিগন্যালেই শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করছেন।

সরেজমিন রাজধানীর আগারগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পল্টন ও শাহবাগ ট্রাফিক সিগন্যাল ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় অন্যান্য দিনের চেয়ে গতকাল সড়কে গাড়ির চাপ বেশি ছিল। গত ছয় দিন ধরে পুলিশের অনুপস্থিতিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা এসেছে। সেই সঙ্গে স্বস্তি ফিরেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাদের এই সেবামূলক কাজ সব মানুষের কাছেই প্রশংসিত হচ্ছে। অনেকে শিক্ষার্থীদের পানি, জুস, ছাতা এবং নানা খাবার দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেয়াল, খুঁটিতে বিভিন্ন রঙের আলপনা আঁকা এবং স্লোগান লিখছেন শিক্ষার্থীরা। সড়ক ও যত্রতত্র ময়লা আবর্জনাও পরিষ্কার করা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কাউটের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। আগে যেসব বাস স্টপেজে বাস থামতে দেখা যায়নি, ছাউনিতে যাত্রীরা বসেনি। এখন সেসব বাস স্টপেজে থামছে, যাত্রীরাও ছাউনিতে বসছেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গণপরিবহন চালক ও যাত্রীদের প্রতি কঠোর হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে ট্রাফিক পুলিশের অভাবে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। সবাই তাদের বাহবা দিচ্ছেন। অনেকে তাদের বিভিন্ন ধরনের খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজের প্রতিফলন দেখা গেছে। কিন্তু এটিও মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষিত নন। এখানে আইন ও নীতিমালা আছে, সেগুলো তাদের জানা না থাকাই স্বাভাবিক।

সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আপদকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছেন, এটাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যারা ট্রাফিকের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের শৃঙ্খলায় ফেরাতে যে কোনো একটি মন্ত্রণালয় বা সংস্থাপনকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে দ্রুতই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিকদের ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাস স্টপেজে ও যাত্রী ছাউনিতে যাত্রী ওঠাণ্ডনামার ব্যাপারে তিনি বলেন, আধুনিক শহরের মতোই বাস স্টপেজে যাত্রী ওঠাণ্ডনামার নিয়ম মানতে বাসচালক ও যাত্রীদের সচেতন করেছন শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে গণপরিবহন থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ আছে। এর আগে গণপরিবহনের কাছ থেকে একটি চক্র চাঁদা তুলেছে, সেই চাঁদার ভাগ ট্রাফিক পুলিশও পেয়েছে। চাঁদাবাজদের চক্র ভেঙে দিলে আগামীতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। আর আইন সবার জন্য সমান হবে।

সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এতে বহু শিক্ষার্থী ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর বিভিন্ন দাবিতে পুলিশ কর্মবিরতিতে গেলে ট্রাফিকের হাল ধরেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেয়ার কথা বলেছেন বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। প্রায় ছয় দিন পর রাজধানী ঢাকার কিছু সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। ধীরে ধীরে ঢাকার সব সড়কে কাজ শুরু করবেন বলে জানান আইজিপি।

ময়নুল ইসলাম বলেন, আমাদের ট্রাফিকে জনবলের সমস্যা নেই। এরইমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল সিগন্যাল থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। এসব সড়কে শিক্ষার্থী, বিএনসিসি ও স্কাউটের সদস্যরাও রয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে যেন শিক্ষার্থীদের কোনো ভুলভ্রান্তি না হয় সেজন্য ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা আগারগাঁও ট্রাফিক সিগন্যালে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মী ও শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছে। সূর্যের তাপমাত্রা ও যানবাহনের ধোঁয়ার মধ্যেই প্রশিক্ষণ ছাড়া ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীদের চেহারায় ক্লান্তিভাব দেখা গেছে। এরপরও মনের জোরে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সব শিক্ষার্থী আনন্দ সহকারে ট্রাফিক সিগন্যালে কাজ করছি। রেড ক্রিসেন্ট থেকে আগেও ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগছে। মানুষ কিছুটা বিরক্তবোধ করছে। কিন্তু আমরা চাই সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা আসুক। যারা গাড়ি চালান তাদের শতভাগ লাইসেন্স ও নিয়মণ্ডনীতি মেনে চলুক। মানুষ কিছুটা শিখে গেলে পরে এই ধারা বজায় থাকবে।

মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব নাহিদ বলেন, সড়কে গাড়ির শৃঙ্খলা ফেরাতে যতদিন না ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্বে আসছেন, ততদিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা দায়িত্বে থাকবে। একই সড়কে বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন চলাচল করছে, এসব যানবাহন লাইন ধরে চালানোর জন্য চালকদের সচেতন করা হচ্ছে। সিগন্যালে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমাদের কষ্ট হচ্ছে তারপরও ভালো লাগছে, মানুষকে সচেতন করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকায় খুশি পথচারী ও গণপরিবহনের চালকরা। রাজধানীর মাতুয়াইল ও গুলিস্তানে নিয়মিত চলাচল করে শ্রাবণ গণপরিবহন। গণপরিবহনের চালকরা বলছেন, আগে সড়কে গাড়ি চালাতে চাঁদা দিতে হয়েছে। এখন সড়কে চাঁদা নেই। পুলিশ নেই কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খলা নেই। শিক্ষার্থীরা কাজ করে যাচ্ছে। খুব বেশি যানজট তৈরি হচ্ছে না।

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা সড়ক ও যত্রতত্র ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করছেন শিক্ষার্থীরা। দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার মুছে পরিচ্ছন্ন করার কাজ করছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত শিক্ষার্থীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা গেছে। তারা গ্লাভস হাতে দিয়ে কোথাও সড়ক ঝাড়ু দিয়েছেন। কোথাও আবর্জনা কুড়িয়ে বস্তায় ভরেছেন। আবার শিক্ষার্থীদের অনেকে দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকার দেয়াল ও সড়কদ্বীপে লেখা স্লোগান মুছে ফেলে আগের চেহারায় নিয়ে আসতে কাজ করছেন।