ঢাকা ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গভবনের চারপাশে নিরাপত্তা জোরদার

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আল্টিমেটাম শেষ হচ্ছে আজ

সংবিধান ও আইনজ্ঞরা যা বলছেন
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আল্টিমেটাম শেষ হচ্ছে আজ

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগের জন্য আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আল্টিমেটামের পর রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে এরইমধ্যে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা বেশকিছু মতামত দিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের স্পিকারের পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, কিন্তু স্পিকার আগেভাগে পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করছেন সংবিধান ও আইনজ্ঞরা। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, আগামী দুইয়েক দিনের মধ্যে তা স্পষ্ট হতে পারে।

গতকাল বঙ্গভবন এলাকা ঘুর দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে বঙ্গভবনের সামনের সড়কে গত মঙ্গলবার বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে কয়েকটি সংগঠন। এসবের রেশ ধরে গতকালও বঙ্গভবনের আশপাশের পরিস্থিতি থমথমে ছিল। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনের চারপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ, সেনাবাহিনীর এপিসি ও জলকামান মোতায়েন রয়েছে। কাঁটাতার দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গভবনের চারপাশে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলটিমেটামের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার সাক্ষাৎ করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বুধবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শনে এলে রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আসিফ নজরুল প্রশ্ন এড়িয়ে যান। তবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে কথা বলেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিজের অফিস কক্ষে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সে সময় (৮ আগস্ট) আমরা সরকার গঠন করেছিলাম। কিন্তু জনগণ যদি মনে করে এই সেটআপের পরিবর্তন প্রয়োজন, সেটা নিশ্চয়ই সরকার দেখবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এটা আইনি সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয় সিদ্ধান্ত হবে।

রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে কোনো ডেভেলপমেন্ট হলে তা জানানো হবে বলে মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বাসভবন যমুনায় বিএনপির প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পর যমুনার সামনে এক ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান শফিকুল আলম। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন। আর বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাউদ্দিন আহমেদ।

সংবিধানে রাষ্ট্রপতি অভিশংসন বা পদত্যাগের বিধান রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুটি উপায়েই জটিলতা আছে। সংবিধানের ৫২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়া আছে। কিন্তু ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সুতরাং সেখানে বাধা আছে। অন্যদিকে সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তা গ্রহণের পরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্পিকার। কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকারও কারাগারে থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নিজে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেই ভালো হয়। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া হতে পারে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করলে সম্ভাব্য পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েও ভাবছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামতও নিচ্ছে সরকার। আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেও তার কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। এরপরই দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা মিথ্যাচার এবং ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল।’ রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে মত দিয়েছেন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেকেই। তারাও রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সংসদ ভেঙে দেয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ নিয়েও উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। তবে কখনোই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধাও ছিল। কিন্তু এখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির বিদায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে বলে মনে করেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল।

এ বিষয়ে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিন বলেন, বর্তমান সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। সুপ্রিমকোর্ট সরকারকে আদেশ দিয়ে বৈধতা দিয়েছেন; কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচমেন্ট (অভিশংসন) করার জন্য তো সংসদ নেই। এখন হয় রাষ্ট্রপতি নিজে পদত্যাগপত্র দেবেন অথবা বর্তমান সরকার তাকে আদেশ দিয়ে সরিয়ে দেবে। বর্তমান সরকারই আবার রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবে। এতে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে না। তিনি বলেন, আগের সরকার যখন পালিয়ে গেল, যারা সফল হলো (বা সরকার গঠন করল) তারা নিজেদের বৈধতা নিজেই সৃষ্টি করেছে। তাই সরকার নতুন রাষ্ট্রপতিও নিয়োগ দিতে পারবে। তবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এসব কাজের বৈধতা দিতে হবে।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলছেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।’ তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর যে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হচ্ছে, তাতে ‘নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর’ হয়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন। সে ক্ষেত্রে সরকার চাইলে ‘জন-আক্সক্ষার আলোকে’ তাকে সরানোর ব্যবস্থা করতে পারে। শাহদীন মালিক বলেন, সরকার পতনের আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন না কিংবা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেককে সরে যেতে বলেছে সরকার। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন পরিস্থিতিকে ততটা সহজ মনে করেন না। তার মতে, গণ-অভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেত। কিন্তু তা না করে কোনোটি বাদ দেয়া হয়েছে, কোনোটি রাখা হয়েছে বলেই জটিলতা। তিনি বলছেন, সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তার নিয়োগকারী সংসদই তো নেই। এখন তিনি তার পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। আবার অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কীভাবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। তবে এখন তিনি (রাষ্ট্রপতি) পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নেই। তাই রাজনৈকি দলসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা হতে পারে। পরের সংসদ এসে এর বৈধতা দেবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন বা দায়িত্ব নেয়ার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহতের পর নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তবে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে খন্দকার মোশতাক আহমদ ৫ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই দিনই সামরিক কর্মকর্তাদের অনুরোধে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সায়েম। এছাড়া গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন।

রাষ্ট্রপতি,সাহাবুদ্দিন,পদত্যাগ,আল্টিমেটাম
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত