বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের শঙ্কা

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ | অনলাইন সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

সীমান্তে দুর্নীতির কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটার কথা স্বীকার করলেও রাখাইন থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে রাখাইনের পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যের কানপেটলেট শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের মিলিটারি কাউন্সিল বা সেখানকার সরকারি বাহিনী। রোববার দুপুরে মিলিটারি কাউন্সিলের সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। গত ২২ ডিসেম্বর মিয়ানমারের চিন রাজ্যের এ গোষ্ঠীটি কানপেলেট শহর দখলের ঘোষণা দিয়ে লড়াই শুরু করে। ওদিকে গত শুক্রবার রাখাইনে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের পতনের পর সেখানকার আন শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে বলে তাদের দাবি। 

এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও সীমান্তবর্তী দেশগুলোর করণীয় বিষয়ে এক জরুরি অনানুষ্ঠানিক সভা হয় থাইল্যান্ডে। এ বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি একই সঙ্গে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রীও। ভারত, চীন, লাওস ও কম্বোডিয়ার প্রতিনিধিরাও এ সভায় অংশ নেয়। মিয়ানমারে ২০২১ সালে বেসামরিক সরকার উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি হয়। এরপর থেকেই ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নিয়েছে।

জান্তা বিরোধী থ্রি বাদারহুড অ্যালায়েন্সের একটি হলো আরাকান আর্মি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এ জোট রাখাইনে ব্যাপক হামলা শুরু করে। এরপর থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি একের পর এক জয় পেয়েছে। এ সংঘাতের কারণে গত কয়েক মাসে অন্তত আশি হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে এসেছে বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আরও রোহিঙ্গা বিভিন্ন পথে আসছে এবং রাখাইনের পরিস্থিতির কারণে সামনে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ব্যাপক হতে পারে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। মিয়ানমার বিষয়ে অভিজ্ঞ নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, সামনে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন অবশ্য বলেছেন, বাংলাদেশে আরেকটি ঢল আসবে বলে তিনি মনে করেন না।

এদিকে ব্যাংককে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কথা রোববার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারানো মিয়ানমার সরকারকে সীমান্ত ও রাখাইন সমস্যা নিয়ে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। মিয়ানমারকে বলেছি, তোমাদের সীমান্তে তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে নন স্টেট অ্যাক্টরের হাতে চলে গেছে। আমরা তো রাষ্ট্র হিসেবে নন স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি না। তোমাদের দেখতে হবে, তোমরা কোন পদ্ধতিতে বর্ডার ও রাখাইনের সমস্যার সমাধান করবে। ঢাকায় গতকাল বলেছেন তিনি। প্রসঙ্গত, নন স্টেট অ্যাক্টর হলো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। বাংলাদেশ সংলগ্ন রাখাইন সীমান্ত এখন সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এ গোষ্ঠীটি গত শুক্রবার পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সদর দপ্তর দখল করে নিয়েছে। এর আগে গত আগস্টে বিদ্রোহীরা পূর্বাঞ্চলীয় লাসিও শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলে মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথম কোনো সামরিক কমান্ডের পতন হয়। এরপর এখন আবার চিন রাজ্যের একটি শহর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার খবর এলো।

এমদাদুল ইসলাম বলছেন, রাখাইনের মূল কেন্দ্র ছিল আন শহরের পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর। এটারই প্রভাব পড়েছে চিন রাজ্যে। কারণ, এটা পশ্চিম কমান্ডের আওতাধীন ছিল। মিয়ানমারে গত বছর নতুন করে সংঘাত শুরুর পর থেকে বিভিন্ন পথে নিয়মিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। এখন সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে যাওয়ার পর সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রশ্নও সামনে আসছে। বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় এ ধরনের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

মিশরের কায়রোতে মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক সময়ে ৮০ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার তথ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ৬০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে এসেছে এবং এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন সীমান্ত দুর্নীতিকে। তিনি বলেন, আসলে বিভিন্ন পথে তারা ঢুকেছে। দুর্নীতি আছে বর্ডারে। এটা আটকানো কঠিন। তবে আরেকটি ঢল আসবে বলে মনে করি না। ঢল আসলে সেটি ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে। এটা অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই, দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর ঢুকে যাচ্ছে। তবে একটা সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে, বিষয়টা এমন নয়। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে ঢুকছে, এটা আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে। তবে আমি মনে করি না, আরেকটি ঢল আসবে। যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর এমদাদুল ইসলাম (অবসরপ্রাপ্ত) বলেছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আরও ব্যাপকভাবে আসবে কিনা, সেটি নির্ভর করবে জান্তা বাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কী ধরনের সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার ওপর। আমার ধারণা, আরও কিছুদিন পর রোহিঙ্গা ঢল নামবে। ব্যাপক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা দেখা দিতে পারে। আর এটি নির্ভর করবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে কী ব্যবস্থা নেয় তার ওপর। তারা কিন্তু এখনও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

মূলত মিয়ানমারে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে জান্তা ক্ষমতা দখলের পর সেখানকার দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রতিবাদ শুরু হয়। যা একপর্যায়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। এর নেতৃত্ব এখন থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের হাতে। কোকাং এমএনডিএএ মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তাং টিএনএলএ তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলে একটি জোট গঠন করেছে; যাকে বলা হয় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। এটি ৩-বিএইচএ নামেও পরিচিত। ২০১৯ সালে তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা আরাকান আর্মির শক্ত ঘাঁটি শান ও রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর কাজে জোর দেয়। আরাকান আর্মি মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যভিত্তিক। কিন্তু এরা ব্যাপক আকারে মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে।

বর্তমানে মিয়ানমারে এরা সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী বিদ্রোহীগোষ্ঠী। এমদাদুল ইসলাম বলছেন, কিছু কিছু জায়গায় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদেরও ব্যবহার করেছে। জান্তা এসব বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। তারা কৌশলে রাখাইনে একটি বিভাজনও তৈরি করেছে। আবার কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ডের পতন হলেও জান্তা সরকার পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের পদক্ষেপ কেমন হবে, সেটার ওপরই রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে আসার বিষয়টি নির্ভর করবে।