ঢাকা ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বছরজুড়েই অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

বছরজুড়েই অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি আসেনি। বছরজুড়েই নিত্যপণ্যের বাজারে ছিল অস্থিরতা। বাড়তি দামের উত্তাপে হাত পুড়ছে ক্রেতাদের।

দাম কমানোর উদ্যোগ হিসেবে শুল্ক কমালেও, আগের মতোই সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি বাজার। কখনো অস্বাভাবিক দাম আবার কখনো বাজার থেকে পণ্য উধাও। চাল, আলু, পেঁয়াজ থেকে ডিম, বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের বাজারই ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

বৈশ্বিক সংঘাত, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, স্বর্ণ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি—এইসব কারণ নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এদিকে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি মজুরি। তাই ভোক্তার কষ্ট ছিল বছরজুড়েই।

চলতি বছরে এমন কোনো নিত্যপণ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন, যার দাম বাড়েনি। যেসব পণ্য একেবারে মৌলিক প্রয়োজন মেটায় (যেমন- চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি) সেসব কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে মাছ, মাংস ও ডিমের মতো আমিষের খাদ্যদ্রব্যে।

ভোক্তাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে চাল, ডিম, আলু, সবজি ও সয়াবিন তেলের মতো বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই কাটছাঁট করেছেন বাজারের তালিকায়। এমনকি দুটি টাকা বাঁচাতে অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছুটেছেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে।

আলোচনার শীর্ষে ডিম

বছরের সবচেয়ে আলোচিত পণ্য ছিল ডিম। গত অক্টোবরে ফার্মের ডিমের ডজন ১৮০ টাকায় ওঠে। ব্যবসায়ীরা বন্যাকে দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, বন্যায় খামারের ব্যাপক ক্ষতি এবং মুরগি মারা যাওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। এ কারণে ডিমের বাজার চড়া হয়ে ওঠে।

বাজারে লাগাম টানতে এক পর্যায়ে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। পাশাপাশি ডিম আমদানির অনুমতি ও শুল্কছাড় দেওয়া হয়। ভারত থেকে কয়েক দফায় কিছু ডিম আমদানি হয়। এর পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে বাজার।

পিছিয়ে ছিল না আলুও

আলুও কম আলোচনার জন্ম দেয়নি। বছরের বেশির ভাগ সময় আলুর কেজি ৫০ টাকার ওপরে ছিল। এমনকি নভেম্বর মাসে এটি ৮০ টাকায় পৌঁছায়। ডিমের মতো আলুও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে নতুন আলুর বাজারে প্রবেশের ফলে দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।

চালের দামও ছড়িয়েছে উত্তাপ

চালের বাজার বছরের শুরু থেকেই অস্থির। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়তে থাকে, যা জুনে কিছুটা কমে। আগস্টে সরকার পতনের পর চালের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়। নভেম্বর পর্যন্ত দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও এখন তা আবার বাড়ছে।

ভোজ্যতেলের তেলেসমাতি

বছরের শেষদিকে রীতিমতো তেলেসমাতি কাণ্ড ভোজ্যতেলের বাজারে। শুল্ক ছাড়ের পরও বিশ্ববাজারে দর বাড়ার অজুহাতে দাম বাড়ান আমদানিকারকরা। দাম বাড়ানোর আগে কয়েকদিনের জন্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন তেল। বাড়তি দরে বিক্রি হয় খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল। সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে দাম বাড়ানোর ঘোষণার দিনই বাজার ভরে গেছে লুকানো তেলে।

বেশির ভাগ সবজির সেঞ্চুরি

এ বছর রেকর্ড গড়েছিল সবজির বাজার। এমন কোনো সবজি নেই, যার দাম বাড়েনি। স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ দাম বাড়ে সবজির। বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষদিকে বেশির ভাগ সবজির দাম শতক পেরিয়ে যায়। যেমন– প্রতি কেজি করলা ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, বরবটি ও কচুরমুখী ১০০ থেকে ১১০, বেগুন ১৪০ থেকে ১৫০, কাঁকরোল ৯০ থেকে ১০০, গাজর ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা ও মুলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এভাবে প্রায় সব সবজির দাম এক প্রকার আকাশ ছুঁয়েছিল।

জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যা ও অতিবৃষ্টির প্রভাবে বাজারে অস্বাভাবিক বাড়ে শাক সবজির দাম। কাঁচামরিচের দামও ছিল চড়া। যদিও বছর শেষে শীত মৌসুমে দাম কিছুটা কমে।

মূল্যস্ফীতি ছিল উদ্বেজনক

পণ্যের দর বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ছিল উদ্বেজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে অনুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে নভেম্বরেও সারাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অক্টোবরে যা ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে যায়। আগস্টে কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়। সেপ্টেম্বরে আরও কিছুটা কমে হয় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। টানা প্রায় আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।

মোটকথা, ২০২৪ সালজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে আমদানিকারক ও করপোরেট কোম্পানির যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ ক্যাবের। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার তাগিদ সংস্থাটির।

ক্যাবের সহ সভাপতি এস এম নাজির হোসেন বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষের যে খাদ্য নিরাপত্তা বা তাদের জীবন জীবিকার সাথে যে জিনিসগুলো জড়িত, এগুলোর ক্ষেত্রে সরকার পজিটিভলি এবং ইফেকটিভলি উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা মাঠ পর্যায়ে সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এখানে তদারকিটা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা।’

সরকারের পদক্ষেপ

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক করতে সরকার গত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অক্টোবরে চাল, আলু, ডিম, চিনি, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানির শুল্ক কমানো হয় এবং পেঁয়াজের শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি, টিসিবি ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু হয়। যেমন, অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ট্রাকে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল, চাল এবং বিভিন্ন সবজি বিক্রি করা হয়।

নতুন বছরে কথায় নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ চান ভোক্তারা।

নিত্যপণ্য,অস্থির,নাভিশ্বাস
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত