দেশে সামগ্রিক অপরাধের হার ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা, অপহরণ এবং খুনের মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ধর্ষণ, চুরি ও সিঁধেল চুরির হার কমেছে।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপরাধের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে সাত ধরনের অপরাধের মোট ১৩,৪৯৬টি ঘটনা ঘটেছে। আগের বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১২,৭১৪টি, যা ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ কম।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়, যার ফলে অপরাধের হারও বেড়ে যায়। বিশেষ করে ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই ও অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, "পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যে পুলিশের আইনি নির্দেশনা না মানার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এতে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। এ কারণে এখন যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে দেশের সব পুলিশ ইউনিটকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে কিছু কিছু অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে। আবার আগের অপরাধের অনেক মামলা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে হয়েছে, এ কারণেও খুনসহ মামলার সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিটি অপরাধের কারণ বের করা এবং পৃথক ধরনের অপরাধের জন্য পৃথক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।"
পুলিশের কাছে সংরক্ষিত অপরাধ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই সময়ে ৪২৬টি ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ১৮২টির তুলনায় ১৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ের মধ্যে দস্যুতার ঘটনা হয়েছে ১,০৩৮টি, যা আগের বছরের ৭৩৫টির চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি।
সর্বশেষ দুই মাসে সারা দেশে ১৪৬টি ডাকাতি ও ৪২২টি দস্যুতা ঘটেছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৬২টি এবং ২৩৫টি। দণ্ডবিধি অনুযায়ী, দস্যুতা তখনই ডাকাতি হিসেবে গণ্য হয় যখন অপরাধীদের সংখ্যা চারজনের বেশি হয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, পুলিশকে অবমূল্যায়ন ও আইনি নির্দেশনা উপেক্ষা করার প্রবণতা বেড়েছে, যা দুষ্কৃতকারীদের অপরাধ করার সুযোগ সৃষ্টি করছে। আইজিপি বাহারুল আলম কে বলেন, এই পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে, উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে অপহরণের ঘটনাও। গত সাত মাসে ৫৪৮টি অপহরণ ঘটেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৯৪টি—৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি। গত দুই মাসে ২১৫টি অপহরণ ঘটেছে, গত বছর একই সময়ে যা ছিল ৯৪টি। ৫ আগস্টের পর অপহরণের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ১৬১টি অপহরণ ঘটেছে।
গণমাধ্যমকে দেয়া এক তথ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস ও ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) মো. রেজাউল করিম বলেন, "অপরাধ এড়িয়ে যাওয়া বা ব্যবস্থা না নেয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এ জন্য প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় মামলা নিতে মাঠপর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।"
ঠিক একই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে খুনের মামলার সংখ্যাও — ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খুনের ঘটনা ছিল ২ হাজার ৮৪০টি, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, এই বৃদ্ধির কারণ হল, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী অপরাধমূলক ঘটনার ফলে নতুন মামলার সৃষ্টি।
সম্প্রতি সরকারের সাথে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, কিছু অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এবং দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরোনো বা অন্য দেশের অপরাধের ভিডিও ছড়িয়ে গুজব তৈরির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা এরই মধ্যে সরকারের নিকট অপরাধ প্রবণতা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার শূন্যতা এবং রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবলের অভাব অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ। তৃতীয় কারণ হিসেবে আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা এবং সুবিচারের প্রতি বিশ্বাসহীনতা দেখানো হয়েছে, যা অপরাধীদের সুযোগ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হত্যা, ডাকাতি, দস্যুতা ও অপহরণের মতো অপরাধ বেড়েছে।
পুলিশের নিকট সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৯৮৬টি খুনের ঘটনায় ৫ আগস্টের পর মামলা হয়েছে। এসব মামলা বাদ দিলে ৫ আগস্টের পর খুনের ঘটনা ১০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা, দখল-চাঁদাবাজি এবং প্রতিহিংসা অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নে, রাজনৈতিক সহিংসতা, লুটপাট এবং চাঁদাবাজির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সরকার পরিবর্তনের পর অতীতের অপরাধের মামলা পুনরায় উত্তোলন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধের ব্যাপক প্রচারণার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ও অ্যাকাউন্ট থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পুলিশের সাইবার ইউনিট ইতিমধ্যেই এসব মিথ্যা তথ্য ছড়ানো কয়েক শ অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করতে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অপরাধের পরিসংখ্যান সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। তাঁরা বলছেন, মামলা বেড়েছে নাকি কমেছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চলাচল নিরাপদ করার বিষয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারা। অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না, সবার মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, "পরিসংখ্যান দিয়ে সব সময় অপরাধ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা যায় না। মামলার এজাহারে দুর্বলতা ও তদন্তে গাফিলতির কারণে অপরাধীরা অনেক সময় পার পেয়ে যায়। এসব জায়গায় তদারকি জরুরি। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আসল চ্যালেঞ্জ।"