বাঙালির স্বাধীনতার প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:০৬ | অনলাইন সংস্করণ
সুভাষ দাশগুপ্ত
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি তার ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করে এবং এই স্বাধীনতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে, যখন বাঙালি জাতির পিতা ৯মাস পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন। সেই দিন থেকে বাঙালি প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়। অনেকের মতে, সে দিনই ছিল প্রকৃত বিজয়ের দিন, ১৬ই ডিসেম্বর নয়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনা না গেলে স্বাধীনতা আজও অনেকাংশে অপূর্ণ থেকে যেত। অনেকে এখনও বলেন ভূট্টো যদি পাকিস্তানের আদালতের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বঙ্গবন্ধুকেফাঁসি দিতে পারতেন তবে জন্মের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশের মৃত্যু হতো।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনও ভূট্টো জাতিসংঘে দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সেই সময়ে তাঁর কর্মকান্ডের সঙ্গী ছিলেন তাঁর কন্যা বেনজির ভূট্টো, তখনতাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮। অনেক সময় ভুট্টো বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাঁর মেয়ের সাথে আলোচনাও করতেন।৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনে। একই দিনে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধে সহযোগীতা করার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের সৈন্য পাঠায়। ৬ই ডিসেম্বর কিসিন্জ্ঞার তার অন্য দুই জনসহযোগীকে নিয়ে এক বৈঠকে একমত হন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, তবে আগামী বছরে এক ব্যাপক দূর্ভিক্ষ দেখাদিবে। ৭ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্র বাঙালির স্বাধীনতা প্রাপ্তি আটকাতে পারে নি। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়ে যায় তখন ইয়াহিয়া খান যত দ্রুত সম্ভব জাতিসঙ্ঘের কাজ শেষ করে ভুট্টোকে দেশে ফিরে আসতে বলেন। এ সংবাদ ইন্দিরা গান্ধীকে খুবচিন্তিত করে তোলে। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হাকে নির্দেশ দেন ভূট্টো পাকিস্তানে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যত নিয়েভুট্টোর চিন্তাভাবনা কি তা নিয়ে সঠিক তথ্য জানার জন্য। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হাগুলি ব্রিটেনকে বেছে নেয়, কেননা ভূট্টো পাকিস্তানে ফেরার পথে ব্রিটেনে যাত্রা বিরতি করবেন। ভারতের ব্রিটিশ ও পাকিস্তান হাইকমিশন সমুহ তৎপর হয়ে উঠে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্হাগুলি, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়া হবেনা এই আভাস ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করার পরওতাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। বেনজির ভুট্টো তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন আমার বাবা নিজে, ও পশ্চিম পাকিস্তানথেকে নির্বাচিত আইন প্রণেতাদের সাথে নিয়ে যখন দুই পক্ষের(পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন সংবিধানপ্রণয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, মুজিব সেই প্রচেষ্টাতে সহযোগীতা না করে বরং পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার লক্ষ্যেপূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারনকে প্ররোচিত করে সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা করেন। বেনজিরের এই উক্তিটা এখানে এনেছি শুধুতাদের জন্য, যারা মনে করেন বঙ্গবন্ধুর ৬দফা ছিল শুধুমাত্র স্বায়ত্ব শাষনের দাবী, স্বাধীনতা নয়।
এদিকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নেয়ার জন্য এক মুহুর্তও ব্যয় না করে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের (সোনার বাংলা গড়া) কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সালে ৬দফা ঘোষণার ৫বছরের মধ্যে এই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, তেমনিভাবে চেয়েছিলেন ৫ বছরের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে বলেছিলেন বিদেশীদের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাওয়া জাতির কোন মর্যাদা নেয়। তাই সোনার বাংলা গড়ার প্রথম ধাপ ছিল ১৯৭৭/৭৮ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।
১০ই জানুয়ারীর জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য ৪দফা ঘোষণা করেনঃ
১ম দফা - জাতীয়তাবাদ
২য় দফা - ধর্মনিরপেক্ষতা
৩য় দফা - সমাজতন্ত্র
৪র্থ দফা - গণতন্ত্র
এই চার দফা রচিত হয় বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক উক্তির ওপর ভিত্তি করে “ পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক এবংশোষিত আর আমি শোষিতের পক্ষে”। এই চার দফা যদি এককভাবে বিবেচনা করি তখন একটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অন্য এক বা একাধিক দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সাথে পরস্পর সাংঘর্ষিক অথবা বিপরীত মুখীও মনে হতে পারে। কিন্তু, চার দফাকে একই সাথে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এরা একে অন্যের পরিপূরক। এখানেই চার দফার অন্তর্নিহিত শক্তি। এরা একে অন্যের সঙ্গে দ্বান্ধিকভাকে যুক্ত এবং একটিকে অন্য একটির সাথে আলাদাভাবে চিন্তা করতে গেলে এই তত্ত্ব বা দর্শনের সঠিকপ্রায়োগীক দিক নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন কিছুতেই সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর পূর্বে একটি সামন্ত্রতান্তিক সমাজ ব্যবস্হাকে শোষণহীন এবং সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্হায় রুপান্তরিত করার দর্শন কেউ দিয়েছিলেন বলে আমার অন্তত জানা নেয়।
বিশেষভাবে লক্ষনীয় যে, এই তত্ত্ব মার্কসবাদের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, কেননা, বঙ্গবন্ধুও সমাজ যে শ্রেনিতে বিভক্ত তা বিশ্বাস করতেন। বলা প্রয়োজন, মহাত্মা গান্ধী সমাজে শ্রেনি বিভাজনের অবস্হান স্বীকার করতেন না আর জিন্নাহকে এ বিষয়ে কোনদিন মাথা ঘামাতেও হয়নি।
আজকের দিনে আমাদের ভেবে দেখতে হবে জাতির পিতার এই দর্শন বাস্তবায়নে আমরা কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আরও সুসংগঠিত করে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করা যাতে করে হাজারও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনারবাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমরা আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারি।