ডোনাল্ড লু-র বাংলাদেশ সফর থেকে বিএনপির অর্জন শুন্য
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৪১ | অনলাইন সংস্করণ
সম্প্রতি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে যে ক’জন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তাদের শেষ জনছিলেন ডোনাল্ড লু। অত্যন্ত দক্ষ এই কুটনীতিক-র কুটনীতিতে সফলতা নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় যে ঘটনাগুলি তুলে ধরাহয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু , ইমরান খান ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেঅনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে।সুতরাং, প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, নির্দলীয় সরকারের প্রবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানে সাধারন মানুষের ভোটের অধিকার যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং মানুষ ভোট দিয়ে ইমরান খানকে জয়ী করেছিল, সেখানে কেন যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খান কে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করল? কেন জনগনের নতামতকে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাহ্য করল? এই ঘটনাগুলি এটাই ইঙ্গিত করে যে, সত্যিকার অর্থে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে, এটাই ডোনাল্ড লূ-র সফরেরঅন্যতম লক্ষ্য বলে বিএনপি যে প্রচার চালিয়েছিল তা সঠিক ছিল না।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে, সমগ্র জাতিকে সঠিক সময়নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। বিএনপি আবারও সেই পথে জাতিকে নিয়ে যেতে চায়। মনে রাখতে হবেদেশে সত্যিকার গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরণের নির্বাচন পদ্ধতি এক বিরাট প্রতিবন্ধক। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবেযে পাকিস্তান এমন একটা দেশ যেখানে একই সঙ্গে দুটি সরকার কাজ করে। একটা হচ্ছে সামরিক সরকার এবং অন্যটা জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকার। আমরা জানি প্রথমটির ক্ষমতা দ্বিতীয়টার থেকে অনেক অনেক বেশি। তাই, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান এক নয়। আজ থেকে ৫২ বছর পূর্বে জাতির পিতা পাকিস্তান থেকে আমাদের মুক্ত করে গেছেন। ডোলান্ড লু পাকিস্তানের এক প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাথে জড়িত ছিলেন সেই ঘটনা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিলেও যে কোন কাজ হবে না, তা তার সফরের ফলাফল দেখে বুঝা যায়।
এবার আসি স্যাংসন নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগের মাধ্যমে এই জাতীয় ঘটানা ঘটানো হয়। এটা হচ্ছে, অবৈধ উপায়ে গরীব দেশগুলি থেকে ডলার রোজগারের যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক বৈধ পদ্ধতি। এই সব ফার্ম থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রচুর পরিমানে ট্যাক্স আদায় করে। বিনা মূলধনে ডলার রোজগারের এর চেয়ে সহজ পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে সম্ভবতঃ এখন অবধি আর নেই। শুধু তাই নয়, স্যাংসনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অনুন্নত দেশগুলির রাজনীতিকেও কলুসিত করে থাকে এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। তাই, এই সহজ আয়ের পথ বন্ধ করা লূ ত দূরের কথা বাইডেন ও পারবেন না। সুতরাং, বাংলাদেশের স্যাংসন এত তাড়াতাড়ি তুলে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের এই সহজ আয়ের পথে মন্দাভাব দেখা দিতে পারে। তাই, সহসা এটাকে তুলে নিলে বাংলাদেশের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি ক্ষতি হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কুটনৈতিক দক্ষতার কারণে স্যাংসনকে ইস্যু করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভবিষ্যতে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় দর কষা কষির অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করতে পারবে এই স্যাংসনকে। তাই, এই স্যাংসন বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা উডিয়ে দেয়া যায় না।যারা এখনও মনে করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দর কষা কষির ক্ষমতা এখনও ৫০ বছর আগের মতই রয়ে গেছে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। বিএনপি এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি দেশের ও বিএনপির জন্য মঙ্গল।
আজকের আলোচনার শেষ বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের “বাংলাদেশে গনতন্ত্র ও মানবাধিকার” প্রসঙ্গ নিয়ে। এর ওপর বলার আগে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ব্রিটিশদের টপকিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম দিকে বিশ্বে একমাত্র শক্তিরূপে আবির্ভুত হয়। অন্যদিকে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জুড়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন কি, ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পাটির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এক লক্ষ বিশ হাজার ভোট পাবার পর, নীতি নির্ধারকদের টনক নড়ে ওঠে। অন্যদিকে ভারত ও চিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে সোভিয়েত রাশিয়ার একচেটিয়া সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যাথা বাডিয়ে দেয়। যুক্তরাজ্যেও ১৯৪৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে, কমিউনিস্ট পাটির সক্রিয় বিরোধীতা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পরাজয়ের অনেকগুলি কারণের একটা বলে মনে করা হয় এবং এর ফল শ্রুতিতে বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র একক শক্তির মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে পারলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জার্মানির শোচনীয় পরাজয়ের পর, যুক্তরাষ্ট্রে এই ধারণার জম্ম দেয় যে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের পৃথিবীব্যাপী তার একচ্ছত্র অধিকার ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়াবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখানথেকেই পৃথিবী ব্যাপী “ স্নায়ু যুদ্ধ” তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ু যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে রাজনৈতিক বক্তব্য সামনে নিয়ে আসে তাহল পৃথিবী ব্যাপী “গনতন্ত্র ও মানবাধিকার” সুরক্ষিত করার অঙ্গীকার, তার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে আসে পৃথিবী ব্যাপী “সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে সাহায্য ও সহযোগীতা করা।১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রিক আন্দোলনে ভাটা নেমে আসে এবং স্নায়ু যুদ্ধের অবসান হয় যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের মধ্য দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ৩২বছর পার হতে চলছে, ইতিমধ্যে নদীর পানি অনেকদুর গডিয়ে গেছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র তার সেই “গনতন্ত্র ও মানবাধিকার” স্লোগানথেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
বলা প্রয়োজন যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ মধ্য- প্রাচ্যের কোন দেশে গনতন্ত্র ও মানবিধাকার আছে তা আমার অন্ততজানা নেয়। সম্প্রতি নিজের দেশের বিচার ব্যবস্হাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে, সৌদী আরবের রাজপুত্রকে সাংবাদিক হত্যার খুনি ছিলবলে দেয়া মার্কিন কোটের রায় বাইডেন সরকার বাতিল করে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়পাওয়া লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাইডেন তার পূর্বসুরী ট্রাম্পের মতো কমান্ডো স্টাইলে ব্রাজিলের পার্লামেন্টে হামলা চালাতে সর্বাত্মক সহযোগীতা করে, যদিও সে চেষ্টা সফল হয়নি। অতি সম্প্রতি মিসরে সরকার বিরোধী আন্দোলেন করার জন্য বিরোধী দলের ৪২ জন সমর্থককে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। অবাক করার বিষয় হল শাস্তি প্রাপ্তদের ভিতর একজন শিশুও ছিল। এ নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কোন মাথা ব্যাথা দেখি না।ইসরাইলে নেতানীয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় ওর পতনের জন্য আন্দোলেন করছে, তাতে কোন সমস্যা যুক্তরাষ্ট্র দেখে না। তাদের যত সমস্যা তা হলে কি শুধু বাংলাদেশের গনতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে? আসলে তা নয়। তার সফরের প্রধান বিষয় ছিলভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হবার ইচ্ছা। নির্দলীয় সরকার, স্যাংসনএবং গনতন্ত্র ও মানবাধিকার কেবল উপসর্গ মাত্র।