ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৭ই মার্চের ভাষণ মূলত বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন: হাজী দুলাল

৭ই মার্চের ভাষণ মূলত বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন: হাজী দুলাল

পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে যে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, সেই জাদুকরী ভাষণের দিন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ আজ।

বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিন অনন্য। ১৯৭১ সালের এইদিনে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন।

ঠিক এইদিনে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দিনটা এখনো আমার কাছে প্রায় স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমার বয়স ৪ থেকে ৫ বছরের মতো হবে। সেদিন ঠিক সকালে আমার বাবা (মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক মরহুম সোলায়মান মিয়া), বড় ভাই (বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন) এবং মাসহ একসাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলাম। তারপর নিত্যদিনের মতো আমি বাবা এবং বড়ভাইয়ের কাছ থেকে দেশের রাজনৈতিক আলাপচারিতা শুনছি। বাবা বললেন, রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিব দেশের অবস্থা ও জনগণের করণীয় সম্পর্কে আজ ভাষণ দিবেন। আমরা সেই ভাষণ শুনবো। তখন আমাদের বাড়িতে একটা রেডিও ছিল। রেডিও সামনে নিয়ে বাবা, বড়ভাই এবং আরো কিছু মুরুব্বি বসলো ভাষণ শুনতে আমাদের আঙ্গিনায়, আমিও বাবার সাথে অধীর আগ্রহে বসলাম ভাষণ শুনতে। আর মা ঘরের কাজ করে ঘরের দরজায় বসে রইল ভাষণ শোনার জন্য। তখন আমি বারবার বাবাকে বলতেছি তিনি (শেখ মুজিব) কখন ভাষণ দিবেন, বাবা বলতেছে এইযে একটু পর। ঠিক দুপুরের পর তিনি ভাষণ শুরু করলেন। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে মনোযোগ সহকারে শুনলাম। সেই কথাগুলো এখনো আমার মনে গেঁথে আছে।

তিনি (শেখ মুজিব) ১৮ মিনিটের ভাষণে দেশের প্রত্যেকটি অবস্থা তুলে ধরেছেন। বাংলার জনগণের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। বাংলার মানুষের অধিকার, বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার। বাংলার মানুষের রক্তে রঞ্জিত রাজপথের। আইয়ুব খানের মার্শাল-ল আইন যা বাংলার মানুষকে দশ বছর গোলাম করে রেখেছে। নির্বাচনে জয়ী হয়েও অধিকার ভোগ বা ক্ষমতা না পাওয়া।

তার সর্বশেষ কথাগুলো ছিল এরকম- মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

এই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা ও জাতীয়তা বোধ জাগরণের মহাকাব্য, বাঙালি তথা বিশ্বের সব লাঞ্ছিত-বঞ্চিত নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির মন্ত্র। ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার চূড়ান্ত প্রেরণা।

এদিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে বাঙালির মহান নেতা বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, "রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।

৭ই মার্চের ভাষণের বড় শিক্ষা হলো কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। বন্দুকের নল বা অস্ত্রের মুখে ‘দাবায়ে` রাখা যায় না। এটাই বিশ্বজনীন সত্য।

লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই সেল ফাইট অন দ্য বিস: দ্য স্পিস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে। অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই ভাষণ।

বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে। তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেছেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার৷ তাই সারবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সার্বজনীন অধিকার।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা। এরপরেই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্খিত মুক্তির লক্ষ্যে।

এই মুক্তির লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়ে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

পরাধীনতা,শৃঙ্খল,মুক্ত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত