ঢাকা ২২ আগস্ট ২০২৪, ৭ ভাদ্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আলোর পথযাত্রী খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ

আলোর পথযাত্রী খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ

খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ ছিলেন আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর অদম্য আত্মার প্রতিচ্ছবি। খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ শৈশবে যে মহারুহের পদপ্রান্তে আশ্রয় গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তা তিনি পূর্ণতা এনেছিলেন মুরর্শিদের আদর্শকে ধারণ করে। তিনি মুরর্শিদের স্বপ্নকে লালন করেছেন গভীর মমতায় ও সাহসী লড়াইয়ে। তাসাউফ বা আধ্যাত্বিকতা অর্থাৎ স্রষ্টার নৈকট্য লাভ ও বিশ্বমানবতার যে জাগতিক দিক নিয়ে পুর্নাঙ্গ হয়েছে ইসলাম। আর সেই আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বমানবতার সমন্বিত রূপের আদর্শকে ধারণ করেই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ও তাঁর অনুসারীদের এগিয়ে চলা। প্রবলভাবে আল্লাহের নৈকট্য লাভের আকাঙ্খা ও স্রষ্টার সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনই হল প্রাথমিকভাবে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) দর্শনের মূল ভিত্তি। তাই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.), খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ ও আহ্ছানিয়া মিশনকে বুঝতে গেলে আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার সমন্বিত রূপকে বুঝতে হয়। আমরা খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্মকে যেভাবে পার্যালোচনা করিনা কেন তার মাঝে এই সমন্বিত রূপকে খুঁজে পাই।

গত ২০২০ সালোর ৭ জুলাই ৮৫ বছর বয়সে খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ জাগতিকতার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আধ্যাত্মিকতার পথে আল্লাহ ও মুরর্শিদের সাথে মহামিলনের উদ্দেশ্যে আলোর পথযাত্রী হয়েছেন। সাতক্ষীরার নলতা গ্রামের হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর দরবার শরীফের অতন্দ্র প্রহরী খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন সকলের ‘‘খাদেম সাহেব”। খাদেম শব্দের আরবি অর্থ দাস, ভৃত্য। তবে শব্দ আর অর্থ যাই হোক না কেন, তিনি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর দেখানো পথে, মানুষকে খেদমত করে খাদেম হতে চেয়েছেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-র বিভিন্ন লেখনিতে দেখেছি তিনি স্রষ্টার সৃষ্টির খেদমত করেই আনন্দলাভ করতে চেয়েছেন ও খাদেম হিসেবে নিজেকে মানবতার সেবায় উজাড় করে দিয়েছেন। ঠিক তেমনি ভাবে খাদেম আনসারউদ্দিন আহমেদ তার মুরর্শিদের আদর্শের অনুসারি হিসেবে স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবা করেই সবার প্রিয় ‘খাদেম সাহেব’ হয়ছেন। তবে খাদেম আনসারউদ্দীন আহমদ থেকে খাদেম সাহেব হয়ে উঠার পথ খুব সহজ ছিলনা, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন আদর্শ অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, সবার শ্রদ্ধেয় ‘খাদেম সাহেব’। একজন মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন হল ইসলামের খেদমত করতে পারা, আর তা খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ পেরেছেন।

যদি কোন মানুষের হৃদয় আলোকিত না হয় তাহলে তাঁর কর্ম কখনো আলোকিত হবে না, এটাই শাশ্বত নিয়ম। খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ এর কর্মের মধ্যেই তার মননশীলতা আর আলোকিত হৃদয়ের আলোক ছটার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ব্যক্তি জীবন, কর্মজীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন এই তিন দিক পর্যালোচনায় তার জীবনের পুরোপুরি না আসলেও কিছুটা অনুধাবন করা যায়।

আমরা যদি তার ব্যক্তি জীবনের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখব, তিনি পূতপবিত্র ও স্বচ্ছ জীবন যাপন করতেন। দুনিয়ার ভোগ-বিলাস পরিহার করে সরল সোজা ও সাদামাটা জীবন যাপন ছিল তাঁর। সর্বপরি অবিবাহিত জীবন, পোশাক বলতে দুই খন্ড সাদা কাপড়, পাদুকাবিহীন চলাচল, নাম মাত্র আহার, আদ্যন্ত নম্রকণ্ঠ, রোজাব্রত পালন করে কাটিয়েছেন জীবনভর, আর সংসার বলতে রওজা শরীফের আর শাহীবাগের ছোট্ট একটা ঘর। জাকজমকহীন জীবনে মুর্শিদের অনুসরনে অতিথি পরায়ণতা সর্বজনবিদিত। আতিথেয়তার বিষয়ে তিনি কখনো সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা আমলে নেননি। পরিশ্রমী আর সময়ানুবর্তিতার মধ্য দিয়েই গড়ে তুলেছিলেন তার আপন ভ‚বন। তাঁর ছিল ব্যক্তিগত সকল চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে একটি কল্যানময় শুভ্র জীবন।

ব্যক্তিগত পরিচয়ে তিনি ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নলতা শরীফের অদূরে পাইকাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা পিতা চৌধুরী মো: এজাহার হোসেন ও মাতা জোহরাতুন্নেছার বড় সন্তান। পরিবারটি অভিজাত ও বিত্তশালী ছিল বলেই জীবন ধারণের কমতির কিছু ছিল না। তবে জীবনের প্রথম ধাক্কাটি আসে খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে। সেই আঘাত কাটিয়ে অত্যন্ত মেধার সাথে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় তিনি অংকে বেশ পাকা ছিলেন, পেতেন এক’শোয় এক’শো। শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পা রেখেই তিনি তাঁর বহুমুখী কর্ম পারিদর্শিতার কথা জানান দেন, সাথে যোগ হয় সুফিসঙ্গীত আর ভক্তিগজলের ভালোবাসা। এককথায় বলা যায় খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ সত্যিকারার্থেই একজন কর্মবীর মহাপুরুষের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। বংশগত দিক থেকে তিনি যেমনি ছিলেন আশরাফ, তাঁর কর্মজীবনও ছিল তেমনি বর্ণাঢ্যময়।

কর্মজীবন শেষে যখন স্বমহীমায় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন, সময়টা তখন ১৯৩০ সাল, খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদের পিতা চৌধুরী এজাহার হোসেন সাহেব খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) আদর্শের অনুরাগী ও ভক্ত হওয়ায় তাঁর বাসায় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) উপস্থিতিতে মাঝে মধ্যে মিলাদের আয়োজন হতো। তখন খাদেম

আনছারউদ্দীন আহমদ তার মুর্শিদকে সেবা করার সুযোগ পেতেন। সেই থেকে খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ তার সান্নিধ্যে পবিত্রতা আর ভালোবাসায় সিক্ত হতেন। এভাবেই একসময় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তাঁর বাবার কাছে তরুণ খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদকে চাইলেন। আর তাঁর বাবা সেই প্রস্তাব লুফে নিয়ে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) খিদমতের জন্য তাকে কবুল করে দিলেন। সেদিন থেকে যুবক আনসারউদ্দীন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন এবং সময়টি তখন ষাটের দশক, আর

আনছারউদ্দীন আহমদ এর খাদেম সাহেব হওয়ার গল্প এখান থেকেই আস্তে আস্তে শুরু। এর পরে খাদেম সাহেবকে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি, সমাজ-সংসার ছেড়ে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটানা খিদমত করার সুযোগ পান খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ।

খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদকে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) কতটুকু ভালোবাসতেন তা তাঁর পত্রসমূহ পর্যালোচনা করলে তার যথাসামান্য কিছু প্রমাণ পাওয় যায়। ১৯৬০ সালে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) লিখিত একটা পত্রে তাঁর কিছু অংশ প্রস্ফুটিত হয়েছে।

তিনি লিখেছেন ‘দু’নয়নের জ্যোতি কবি আমার, তোমার কবিত্ব আমার শক্ত অন্তরকে একদম বিগলিত করে দেয়। ঐ হাসি মুখখানি শয়নে স্বপনে মনে পড়ে। কত ইচ্ছা হয় দুই লোকমা বাবার মুখে তুলে দিই, আর ধন্য হই। তুমি বালক হয়ে এতাধিক মহব্বত এই গরীবের জন্য পোষণ কর, সেজন্য আমি কত গর্বিত। ইচ্ছা হয় বুকখানি বিছিয়ে দিই তোমার জন্য। কিন্তু নিষ্ঠুর তুমি, কখনো কোল দিতে চাও না।’ এ যেন মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি ও তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু শামস্-ই তাবরিজের ভালোবাসার ও অভিব্যক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রুমির কবিতায় শামসের কথা বারবার এসেছে এবং তাদের ভালোবাসার সম্পর্কের ধরণে প্রায় প্রত্যেককেই বিস্মিত করে। ঠিক তেমনি খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদের আত্ম উৎসর্গ কতটা ভক্তি ও অনুরাগে সিক্ত তা সহজেই অনুমান যোগ্য।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ও খাদেম আনছারউদ্দীন আহমেদের ভালোবাসার তুলনা ও দু’জনের সম্পর্ক কতটা নিবিড় তা শুধু শামসের জন্য রুমির ভালোবাসার সাথে তুলনিয়।

অনেকে মনেকরেন মাওলানা রুমির আধ্যাত্মিক গুরু শামস্-ই তাবরিজ এমন একজন ব্যক্তি যিনি সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন, যিনি পূর্ণ উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন। যখন কেউ উপলব্ধি অর্জন করে সাধনার উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত হয় তখন তিনি সকল প্রকার পার্থিব যোগাযোগের অতীত হয়ে যান, সকল ভাষা, সকল ধারণা, সকল ভাব তাঁদের বহু নিম্নে অবস্থান করে এবং সেই অবস্থায় তাঁদের যা প্রয়োজন হয় তা হলো একজন যোগ্য মুখপাত্র। শামস্-ই তাবরিজ ক্ষেত্রে মাওলানা রুমি ছিলেন তার সেই কাঙ্খিত মুখপাত্র, আর খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ক্ষেত্রে খাদেম আনছারউদ্দীন আহমেদ ছিলেন তার যোগ্য মুখপাত্র।

এখন খাদেম সাহেবের ব্যক্তি জীবনের বাইরে তাঁর কর্মময় জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। যারা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-কে বুঝেন তারা একটা জায়গায় সবাই একমত যে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার বিষয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে ছিলেন। আর এই বিষয়টি জন্য অন্যান্য পীর, সুফি ও মুরর্শিদ থেকে তাঁর ব্যবধান রচনা করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি খাদেম সাহেব আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার সমন্বিত পথকে অনুসরন করে, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ভাবনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।

সীমিত পরিসরেও যদি আমরা উল্লেখ করি তাহলে আমরা দেখব ১৯৬৫ সালে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর ইন্তেকালের পরে পাক রওজা শরীফ নির্মাণের কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে সম্পন্ন করেছেন। পাশাপাশি রওজা শরীফের চারপাশকে সুপরিকল্পিত স্থান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যার কল্যাণে হাজার ভক্তের আবেগ অনুভূতিতে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর এ মানবপ্রেম ও জনকল্যাণের আরও কিছু নিদর্শন হচ্ছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ। যেসব সৃষ্টি তার জীবনকে মানুষের মনের মনি কোঠায় স্থান করে দিয়েছে তার মধ্য অন্যতম, নলতার প্রি-ক্যাডেট স্কুল স্থাপন, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা প্রি-ক্যাডেট এন্ড হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় জমি দান, নলতা আহ্ছানিয়া মিশন রেসিডেন্সিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠা, ঢাকার উত্তরায় নলতা শরীফ আহ্ছানিয়া মিশন এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, আহ্ছানিয়া মিশন চক্ষু এন্ড জেনারেল হাসপাতাল-এর প্রতিষ্ঠা এবং খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের মাধ্যমে ‘আহ্ছানিয়া মিশন শিক্ষা পরিষদ’ গঠন করে নলতা শরীফ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য শিক্ষার্থীর বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।

নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিটি কর্মকান্ডে খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদের ভাবনা ও তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা সম্প্রসারিত করেছে। আজকে নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের যে কর্ম বিস্তৃত হয়েছে তার অন্যমত রুপকার ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় মিশনে যত ঝড়-ঝাপটা এসেছে তাঁর ছোঁয়াতেই উত্তরণ ঘটেছে। মানব কল্যাণে যে সম্পদের প্রয়োজন হয় তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান দেয়ার উদ্যোগ তিনিই নিতেন। আর এ পথ যে মসৃণ ছিল, তা নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মিশনগুলোকে সক্রিয় করতে তাঁর ভ‚মিকা স্মরণযোগ্য। তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছেন ভক্তকুলের মনের ব্যাকুলতা নিরসনে।

আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন নামাজ, সরা বছর রোজা পালন করেছেন, প্রতি নিয়ত মানুষের জন্য দোয়া, তাবিজ প্রদান, বৃহত্তম ইফতার আয়োজন করে রোজাদারের মুখে ইফতার তুলেদিয়েছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান, ইতেকাফ আয়োজনে সহযোগিতা, মৃত মানুষের জানায়ায় অংশগ্রহণ, তাঁর মুর্শিদের অনুশ্রীত পথে বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস পালন, মিলাদের আয়োজন ইত্যাদি। প্রতি বছর ওরশ শরীফ আয়োজনে তাঁর ভ‚মিকার কথা অকপটে সকলে স্বীকার করেন, তিনি তিনবার ভক্ত অনুরাগীসহ পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। এছাড়া নলতা দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, নলতা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান স্মরণযোগ্য। তার কর্মই তাকে সবচেয়ে সম্মানিত বা মহিমান্বিত অর্থাৎ আশরাফ করেছে। কবি আবুল হাশেমের কথায় “নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়, সেই আশরাফ জীবন যাহার পূণ্য কর্মময়” তাই আমরা বলতে পারি খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ আশরাফ হয়েছেন তার কর্মময় জীবনের জন্য।

খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ পূর্ন শরিয়তের নির্দেশনা পালনের পাশাপাশি তাসাউফচর্চা করেছেন। তারা বিনম্রতা, অহিংসা, নিরহংকার, অকৃত্রিমতা, প্রেমবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খানবাহাদুর আহছানউল্লা (র.) আদর্শের প্রসার ঘটিয়েছেন। নৈতিকতার বর্তমান চরম অবক্ষয়ের যুগে বিশ্বমানবতাকে পুনরায় নৈতিকতায় ফিরিয়ে আনতে তিনি প্রকৃত সুফিবাদচর্চা উৎসাহিত করেছেন। মানুষকে খাঁটি মানুষ, পরিপূর্ণ মানুষ আর সমাজ-সভ্যতা ও মানবতার জন্য উপযোগী নিয়ামক শক্তিসম্পন্ন সত্যিকারের মানুষে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। এভাবেই তিনি মুর্শিদের আদর্শকে অধিক স্থায়ী ও টেকসই করেছেন।

প্রকৃত অর্থে কর্মজীবন থেকে তিনি কখনো অবসর গ্রহণ করেননি। পুরো জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি একের পর এক কর্ম সম্পাদন করেছেন এবং সবখানেই তিনি আশাতীত সফলতা লাভ করেছেন। তিনি একজন অসাধারণ মানবপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। তার ছায়াতলে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয়েছে। মুর্শিদের দেখানো পথে তিনি যে প্রেমদর্শন লাভ করেছেন তা ছিল ইমানের জ্যোতি, সর্বত্র বিরাজমান আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের প্রতি পবিত্র প্রেম, কুরআনের বাণীর ওপর অটল বিশ্বাস, সত্যিকার পীর, মুর্শিদ, আউলিয়া ও বুজুর্গদের প্রতি অগাধ ভক্তি এবং সর্বপরি মানবপ্রীতি। নর-নারী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে তিনি তার ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ করতেন। তাঁর প্রতিটি অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থাকতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অন্যান্য ধর্মের মানুষ এবং ভিন্ন মত ও পথের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। খাদেম সাহেব নিজেকে খানবাহাদুর আহছানউল্লা (র:) এর মাঝে বিলীন করেছিলেন এবং তাকে ভক্তি প্রদর্শনের প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত বস্তুতে পরিণত করেছেন। তার এই মানব প্রেম ছিল জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সার্বজনীন।

বিশ্বের খ্যাতিমান উর্দু কবি মুহাম্মদ ইকবালের মতে, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত পুরুষ বা মর্দে মুমিন, যিনি জীবনযুদ্ধে কেবল তিনটি জিনিসকে তার তলোয়ার বা হাতিয়ার বানিয়ে নেন। সে তিনটি মহামূল্যবান অস্ত্র হচ্ছে ─ সুদৃঢ় ইমান, অনবরত কর্মতৎপরতা এবং ভূবনজয়ী ভালবাসা তথা সার্বজনীন প্রেম। এ সংজ্ঞার আলোকে খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ সত্যিকারার্থেই এমন একজন ইনসানে কামেল বা মর্দে মুমিন, যাঁর জীবনে আমরা ওই তিনটি গুণেরই বিরল সমাবেশ প্রত্যক্ষ করেছি।

সফলতা বলতে অধিকাংশ মানুষই কেবলমাত্র বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানই বুঝে থাকে বা নিত্যদিনের কর্মকেই বুঝেন। কিন্তু আমরা দেখেছি খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ বাহ্যিক ও অন্তনিহিত কর্মের মালা গেঁথেছেন এবং সফলতার সাথে তার উপর গুরু দয়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। জড়জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গত ৭ জুলাই ২০২০ খাদেম আনসারউদ্দীন আহমেদ ¯্রষ্টার কাছে ফিরে গেছেন। এ যাত্রা তো পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলনের, তাঁর চলে যাওয়া মানে মহামিলনের পথে আলোর পথযাত্রী হওয়া।

সূত্র:

১. দিওয়ান ই শামস ইতাবরিজ

২. নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশন ওয়েব সাইট

৩. মৌলভী আনছারউদ্দীন আহমদ: সততায়, পবিত্রতায় আর প্রেমিকতায় উদ্ভাসিত এক জীবন, মো: মনিরুল ইসলাম, পরিচালক, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট

লেখক: ইকবাল মাসুদ

পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

খাদেম আনছারউদ্দীন আহমদ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত