পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের প্রায় ২৭০ কোটিরও অধিক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এর একটি ব্যাপক প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজে। যোগাযোগের সহজীকরণ এবং হাতের কাছেই পরিচিতি - অপরিচিত সকলের সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, পছন্দ অপছন্দের সাথে মতামত জানানোর সুযোগ থাকায় আমাদের প্রতিদিনের রুটিনে এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আপনি জানেন কি আপনার শরীর, মন এমনকি জীবনের উপরও পড়ছে এর প্রভাব!
চলুন জেনে নেই এমন কয়েকটি প্রভাবের কথা:
ডিজিটাল কোকেন- অনলাইন আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা এখন ডিজিটাল কোকেন নাম দিয়েছেন। ফেসবুক যারা ব্যবহার করেন তাদের অনেকেই বলেছেন একটু পর পর তাদের ফেসবুকে ঢুকে দেখতে ইচ্ছে করে নতুন কোন নোটিফিকেশন এলো কিনা? আর একবার ঢুকলে কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় তা যেন তারা টেরই পান না।
শুনে মাদকাসক্তির মত মনে হচ্ছে কি? ব্রেন স্কানে মাদকাসক্ত আর অনলাইন আসক্তদের একই রকম ছবি দেখা গেছে। দুজনেরই মস্তিষ্কের সামনের দিকে হোয়াইট ম্যাটার গুলো ক্ষয়ে যাওয়া। ব্রেনের হোয়াইট ম্যাটারগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের আবেগ, মনোযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা। কাজেই সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রনহীন ব্যবহার আপনার আবেগকে ভারসাম্যহীন করতে পারে, নষ্ট করতে পারে আপনার মনোযোগ এবং সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতাকে।
মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক ধরনের কেমিক্যাল নিঃসরন হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু হঠাৎ যদি এমন কিছু ঘটে যা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো, তখন আকস্মিক ভাবে বেড়ে যায় এই ডোপামিনের প্রবাহ এবং ভালো লাগাকে আরও বাড়াতে ব্রেন ঐ কারনটাকেই আরও বাড়াতে বলে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডোপামিন এবং ভালো লাগার এই সাময়িক অনুভূতিকে ক্রমাগত বাড়াতে চাওয়ার নামই আসক্তি।
মনোযোগের ক্ষমতা নষ্ট - কেউ কেউ ভাবতে পারেন কাজের ফাকে ফাকে একটু সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢু মেরে আপনি একজন দক্ষ মাল্টি টাস্কার হয়ে উঠছেন। ভুল!! সোশ্যাল মিডিয়া আর মাল্টি টাস্কিং দুটো ভিন্ন জিনিস। গবেষণায় উঠে এসেছে খুব বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তাদের একাধিক কাজের দক্ষতা অন্যদের চেয়ে কম। বরং তাদের মনোযোগ এত বেশি বিক্ষিপ্ত যে এর ফলে তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে অন্যদের চেয়ে দ্রুত।
বিষয়টা কেমন? ধরুন গভীর মনোযোগ দিয়ে আপনি কোন কাজ করছেন, ঠিক সেই মুহুর্তে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে কেমন লাগে? বিরক্ত লাগেনা? মনে হয়না কোথায় যেন মনোগের সুতোটা ছিড়ে গেল?
আচ্ছা দাড়ান! দাড়ান!! মোবাইলটা কি আসলেই বেজেছে?,,, ভৌতিক কল!
ফোন কল বা (এসএমএস) আসেনি কিন্তু আপনার কি মনে হলো মোবাইলটা আসলেই বেজে উঠেছে? বা প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনসেটটা কাপছে!! যদি তাই হয় তা হলে বুঝতে হবে আপনি ফ্যানটম ভাইব্রেশন বা (ভৌতিক কল সিনড্রোমে) আক্রান্ত । আর এর কারন হলো আধুনিক সময়ে মোবাইল ফোনের অতি ব্যবহার। মাত্রারিক্ত এই আসক্তি মস্তিষ্কের ভিতরে হ্যালোসিনেশন বা বিভ্রম তৈরি করছে।
একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যতজন শিক্ষার্থীকে এই কথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তাদের ৯০ ভাগেরই এই ফ্যানটম ভাইব্রেশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্মার্ট ফোন আমাদের এতবেশি আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে একটু পরপরই আমরা নিজের অজান্তে মোবাইল ফোন হাতে তুলে নেই এবং দেখতে ইচ্ছে হয় কেউ (এসএমএস) বা মেইল পাঠালো কিনা বা সোস্যাল মিডিয়ায় নতুন কিছু এলো কিনা।
আত্নকেন্দ্রীকতা - শুনে অবাক লাগছেনা? এটাই বাস্তব যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনাকে প্রতিনিয়ত অসামাজিক ই করে তুলছে। বিচ্ছিন্ন আর স্বার্থপর বানাচ্ছে। কিভাবে?
গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষ যখন সামনা সামনি আরেকজন মানুষের সাথে কথা বলে তখন ৩০-৪০ ভাগ সময় নিজের বিষয় কথা বলে। বাকিটা শোনে। কিন্তু একজন মানুষ যখন সোস্যাল মিডিয়ায় সময় দেয় সে ৮০ ভাগ সময় ব্যায় করে নিজেকে নিয়ে বলতে। সুতরাং বলা চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনাকে প্রতিনিয়ত আত্নকেন্দ্রীক ই করে তুলছে না বরং পর্দার আড়ালে আপনার কাছের মানুষ গুলো থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছে।
স্বপ্নভঙ্গ- আমরা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় তারপর প্রেম বা পরিনয়ের কথা শুনি কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে এদের একটা বড় অংশই পরে আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেনা। কারণ ভার্চুয়াল জগতের মানুষ আর রক্তমাংসের মানুষ বেশিরভাগ সময়ই এক হয়না। বায়বীয় জগতে যে তরুনকে অসাধারণ প্রেমিক পুরুষ মনে হয়েছিল বাস্তবে তাকে বদমেজাজী আর খুনসুটে স্বভাবের আবিস্কার করাটা বিচিত্র কিছু নয়। তেমনি অপ্সরাদের মত দেখতে ফেসবুকের আকর্ষনীয় তরুনী যে বাস্তবে এমন হবে তার কি নিশ্চয়তা আছে আপনার কাছে?
যৌন হয়রানি, অর্থনাশ, সম্মানহানী এমনকি আত্নহত্যায় বাধ্য হওয়ার ঘটনাও ঘটছে কোন কোন ক্ষেত্রে। কেউবা ক্রমাগত প্রতারিত হতে হতে হারিয়ে ফেলে বিশ্বাস করার সক্ষমতাটুকুও। অনেকেই বিষন্নতায় ডুবে হাটুর উপর তাল ঠুকে "দু 'আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দিতে চায় জীবনের সব অপ্রাপ্তিগুলো। পর্দার আড়ালে রয়ে যায় অনেক অনিশ্চিত জীবনের ইতিহাস। ফিরে গিয়ে আরও অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছে করে,,,, কিন্তু কি লাভ বিষাদ বাড়িয়ে!!
লেখক - ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা), শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।