ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গণিতের গল্প: অজানাকে জানার নীরব ভাষা

গণিতের গল্প: অজানাকে জানার নীরব ভাষা

একটি শিশুর যখন প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু হয়, তার হাতে দেয়া হয় রঙিন পেন্সিল, বর্ণমালার বই আর একদম গোড়ার একটা সংখ্যা বই। সংখ্যাগুলো তখন কেবল চিহ্ন—১, ২, ৩... কিন্তু সময়ের সাথে এগুলো হয়ে ওঠে জাদুময় ভাষা। ভাষা—যার মধ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর গঠন, প্রকৃতির খেলা, প্রযুক্তির চাকা, এমনকি ভালোবাসা আর সঙ্গীতের ছন্দও।

গণিতকে ঘিরে একটা প্রচলিত ভুল ধারণা আছে—যেন এটা কঠিন, রোবটিক, হৃৎস্পন্দনহীন একটা বিষয়। অথচ গণিত আসলে কল্পনার মুক্ত রাজ্য। নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার পেছনের যে চিন্তাধারা, তা ছিল গাণিতিক যুক্তির আলোকে প্রশ্ন তোলা—“কেন?”। আর সেই প্রশ্নই জন্ম দিল মহাকর্ষ তত্ত্বের।

পৃথিবীর বহু জটিল ঘটনাই আসলে গণিত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মেঘের আকার, গাছের ডালপালার গঠন, নদীর বাঁক কিংবা হৃদস্পন্দনের ছন্দ—সব কিছুতে এক ধরনের গাণিতিক প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্যাটার্নকে বলে ‘ফ্র্যাক্টাল’। প্রকৃতির মধ্যে এত সূক্ষ্মভাবে গণিত মিশে আছে যে, একে অস্বীকার করাই অসম্ভব।

গণিতের সবচেয়ে মোহনীয় দিক হলো, এটি প্রশ্ন করতে শেখায়। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে—"পৃথিবীর সবচেয়ে মৌলিক সত্য কী?" তখন হয়ত অনেকেই বলবে, ধর্ম, দর্শন বা বিজ্ঞান। কিন্তু এই সবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি আসলে সংখ্যা। সংখ্যা না থাকলে ধর্মীয় ক্যালেন্ডার তৈরি হতো না, দর্শনের যুক্তি সাজানো যেত না, বিজ্ঞানের পরীক্ষার ফল মাপা যেত না।

আজ আমরা যে প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত—স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সব কিছুর মূলে রয়েছে গণিত। একটা মোবাইল অ্যাপে ‘লাইক’ বাটনে ক্লিক করলেই যে অ্যালগরিদম কাজ করে, সেটাও এক ধরনের গাণিতিক রূপান্তর। আমরা যে প্রতিদিন গুগলে কিছু না কিছু খুঁজি, সেই সার্চ ইঞ্জিনের পেছনের কাঠামোটিও সম্পূর্ণ গণিতনির্ভর।

বাংলাদেশেও গণিতচর্চার ইতিহাস নতুন নয়। মধ্যযুগে বাঙালি গণিতবিদ ভাস্করাচার্য ও জগন্নাথ সমাজে গণিতের চর্চা করতেন। ব্রহ্মগুপ্তের বীজগণিত, আর্যভটের ত্রিকোণমিতি—সবই আমাদের দক্ষিণ এশীয় জ্ঞানভাণ্ডারের অংশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই ইতিহাস আমরা জানি না বা জানাতে আগ্রহী হই না।

আধুনিক বাংলাদেশেও গণিতে অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন, যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা করছেন, কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত এখনো অনেকের কাছে ভয়ংকর একটি বিষয় হয়ে আছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে গণিত শেখানোর পদ্ধতিতে যতটা বেশি অনুশীলন আর মুখস্থের উপর জোর দেওয়া হয়, ততটাই কম গুরুত্ব দেওয়া হয় গণনার পেছনের যুক্তি বোঝাতে।

যে শিক্ষার্থী অঙ্কে নম্বর কম পায়, তাকে সহজেই “দুর্বল” বলে ধরে নেয়া হয়। অথচ হয়ত তাকে সংখ্যার বদলে প্যাটার্ন বা ভিজ্যুয়াল চিন্তাধারা দিয়ে শেখালে সে সহজেই সমস্যার সমাধান করতে পারত। এখানে প্রশ্ন আসে—গণিত কি সত্যিই সবার জন্য একইভাবে শেখার বিষয়? নাকি প্রত্যেকের শেখার ধরন অনুযায়ী পদ্ধতি বদলানো উচিত?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গণিতকে বিচ্ছিন্ন কোনো অ্যাকাডেমিক বিষয় হিসেবে না দেখে একে অন্যান্য বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করে শেখানো। গণিতের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা, জেনেটিক্স বিশ্লেষণ, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের মডেল তৈরি করা সম্ভব। তাহলে কেন আমরা শুধুই ‘x’ আর ‘y’ এর অজানা মান খুঁজেই সন্তুষ্ট থাকব?

অনেক দেশে “গণিতকে গল্পের মতো শেখানো” নামে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গল্পের মাধ্যমে গণিত শেখালে শিশুদের কল্পনার জগতে সংখ্যাগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও এমন কিছু কাজ শুরু হয়েছে, তবে তা এখনো ক্ষুদ্র পরিসরে। এই প্রয়াসগুলো বড় আকারে সম্প্রসারিত করতে হবে।

গণিতকে যদি আমরা জীবনের অংশ না বানাতে পারি, তাহলে সেটি কেবল পরীক্ষার হল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। অথচ বাস্তবতা হলো, আমাদের আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো—বিশ্ব উষ্ণায়ন, খাদ্য সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য সমস্যা—সবকিছুর সমাধানেই দরকার কঠিন বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। আর এগুলোর ভাষা হলো গণিত।

গণিতচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হলো মনোভাবের পরিবর্তন। একজন শিক্ষার্থী যদি ভুল করে, তাহলে সেটা তার ব্যর্থতা নয়, বরং শেখার একটি ধাপ। “ভুল করলে শিখব কীভাবে?”—এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হলে গণিত কখনো আনন্দের বিষয় হবে না। গণিতে ‘রেজাল্ট’ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘প্রক্রিয়া’।

একটা অংক সমাধানের সময় আমরা কেবল একটা সঠিক উত্তর পাই না, বরং আমরা ধাপে ধাপে চিন্তা করা শিখি, ভুল থেকে শিক্ষা নিই, ধৈর্য রাখি এবং নতুন করে চেষ্টা করতে শিখি। আর এই সমস্ত গুণই একজন মানুষকে জীবনে সফল হতে সাহায্য করে।

গণিত আসলে আমাদের শেখায়—জীবনের প্রতিটি সমস্যার একটি সমাধান আছে। হয়ত সেটা আজ পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু যুক্তি আর ধৈর্যের মাধ্যমে তা একদিন মিলবেই। এটাই গণিতের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।


লেখক: মোঃ সোহাগ হোসেন, সহকারী শিক্ষক (গণিত), শিরোমণি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ফুলতলা, খুলনা।

গণিত,গল্প
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত