শহীদের কবর হয়না, কবর থাকে মৃত মানুষদের
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ
রামিম হাসান
#গল্প_নয়_সত্যি, ডিসেম্বর ৮, ১৯৭১।।
কুয়াশার জন্য খুব বেশি দূর দেখা যায় না। এর মধ্যে কনকনে বাতাস। কিশোর এক মুক্তিযোদ্ধা রাস্তা ধরে হেটে যাচ্ছেন চাদর মুড়ি দিয়ে। ঠিক পেছনে ১৫-২০ জন রাইফেলধারীর একটি দল; সাথে তাঁর বাবা। তাঁরা যাচ্ছেন গড়াই নদীর দিকে।
সেখানে পৌছুতে পারলেই কিশোরের কাজ শেষ। বাকি কাজ তখন অস্ত্রধারীদের। নিশ্চিন্ত কিশোর তাঁর সমস্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাতাসের বিরুদ্ধে গায়ের চাদরটাকে ধরে রাখতে।
তিনি জানেন, নদীর পাড়ে পৌছেই তাঁকে হত্যা করা হবে। কারণ তাঁর সাথের রাইফেলধারীরা সহযোদ্ধা নয়। একই পরিণতি হবে তাঁর বাবার ভাগ্যেও।
তিনি হাটছেন সবার আগে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। কোন ভ্রুক্ষেপও নেই। কারণ তিনি জানেন যেভাবেই হোক তিনি বেঁচে যাবেন। কীভাবে তা এখনো জানেন না। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ঠান্ডা মাথার চেয়ে বড় কোন অস্ত্র পৃথিবীতে তৈরি হয়না। তাই মৃত্যুর খুব কাছে এসেও তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পথ চলছেন। আর অপেক্ষা করছেন সঠিক সময়ের জন্য। যে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
কিশোরের এই বিশ্বাস জন্মেছে অতিরিক্ত উপন্যাস পড়ার কারণে। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র মাসুদ রানা শতাধিক মিশনে এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফিরেছে।
এসব চিন্তা করতে করতে পিঠে রাইফেলের বেয়নেটের খোঁচায় কিশোর ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসেন। আবিস্কার করেন নদীর ঠিক কিনারে দাঁড়িয়ে তিনি। কিন্তু কোথায় সঠিক সময়? কোথায় তাঁর উপন্যাসের নায়কের বারবার বেঁচে ফেরার গল্প?
তিনি বুঝে যান জীবন আদতে গল্প, উপন্যাস নয়। কিন্তু সেই বোধদয় তাঁর হল মৃত্যুর খুব কাছে এসে। ঘাড়ের পিছনে দু-তিন হাত দূরে যমদূত রাইফেল লোড করছে। বাকিরা ১৫-২০ হাত দূরে অপেক্ষা করছে গুলির শব্দের জন্য।
কিশোর উপলব্ধি করেন নদীর কাছে এসে বাতাসটা আরো তীব্র হয়েছে। তিনি অনেক কষ্টে গায়ের চাদরটা ধরে আছেন।
ঠিক এসময়ই তাঁর ঠান্ডা মস্তিষ্ক কাজ দেখাতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর সঠিক সময় চলে এসেছে। সেটাকে এখনই কাজে লাগাতে হবে। কিশোর মুহুর্তেই হয়ে ওঠেন একাত্তরের মাসুদ রানা।
দুহাতে কষ্ট করে এতক্ষণ ধরে রাখা চাদরটাকে ছেড়ে দেন তিনি। তীব্র বাতাসে সেটা জড়িয়ে ফেলে রাইফেলধারীর চোখ আর মুখ। যমদূত কিছু বুঝে ওঠার আগেই নদীতে ঝাপ দেন কিশোর। যমদূতও তাঁর সাথে লাফিয়ে পড়ে পানিতে। এবার কিশোরের মাথা আরো খুলে যায়। শত্রুকে কৌশলে নিজের কাছাকাছি রেখে মাঝ নদী পার হয়ে যান তিনি।
নিজেদের লোক টার্গেট রেঞ্জের কাছাকাছি থাকায় তীরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য রাইফেলধারীরা উপর্যুপরি গুলি চালাতে পারেনা।
কিশোরকে ধরতে না পেয়ে মাঝ-নদী থেকে ফিরে আসে যমদূত। এরপর শুরু হয় বৃষ্টির মত গুলি বর্ষন। ততক্ষণে ওপারে পৌছে গেছেন কিশোর। পাড়ে উঠে হাটা শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের দিকে। ওপার থেকে রাজাকারের দল আবারো বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে। এবার তিনটি গুলি তাঁর শরীরে ঢুকে যায়। মাটিতে পড়ে যান ৭১-এর কিশোর মাসুদ রানা।
এক পায়ের হাড় ভেঙ্গে চামড়ার সাথে কোন মতে ঝুলে আছে। দুটো গুলি হাত ফুটো করে বেড় হয়ে গেছে।
বালির মধ্যেও রক্তের স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে কিশোরের, প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু তিনি জানেন, চোখ বন্ধ করলেই সব শেষ। স্বাধীন দেশের পতাকা না দেখে কোন ভাবেই যাবেন না তিনি। প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন চোখ খুলে রাখার জন্য।
বিস্তির্ণ তীরে একা পড়ে আছেন তিনি। চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে দেহ। ওপাড়ে তাঁর বাবা স্তব্ধ নয়নে দেখছেন নিজের সন্তানের মৃত্যু।
**অলৌকিকভাবে সেই কিশোর সেদিন বেঁচে যায়। কিন্তু তাঁর বাবাকে হত্যা করে রাজাকার বাহিনী। মৃত্যুর আগে বাবা জেনে যেতে পারেননি তাঁর সন্তান যে বেঁচে ছিলেন।
আর সেই কিশোরের সন্তান আজ তাঁরই কাহিনী লিখছে, যে কখনো তার দাদার কবর দেখেনি। কারণ শহীদের কবর হয়না। কবর থাকে মৃত মানুষদের।
(রাজাকারেরা হত্যার পর কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বাবাকে নদীতে ফেলে দেয়। তাঁর লাশ কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর গত বছর ২০১৯-এর ২১শে নভেম্বর ওই গড়াই নদীর পাড়েই সেই কিশোরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানো হয়।)
লেখক- রামিম হাসান, ব্র্যাক কর্মকর্তা (পরিচালনা, ব্র্যান্ড এবং নেটওয়ার্ক) ও সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার, সময় টিভি ও নিউজ২৪ টিভি।