প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর থেকে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব যেন পিছু ছাড়ছে না জাতীয় পার্টিতে। এ দ্বন্দ্বের জেরে পার্টিতে চলেছে ভাঙাগড়ার খেলা। যার শেষ এখনও হয়নি। সম্প্রতি পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। আর তা মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। তবে তা সবশেষ কতটা কেটেছে- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে।
দলে শীর্ষ পর্যায়ে এমন দ্বন্দ্বের মধ্যেই আজ ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। ১৯৮৬ সালের এ দিনে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরশাদের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ বছর দেশ পরিচালনা করে জাতীয় পার্টি। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর দীর্ঘ চড়াইউতরাই পেরিয়ে দলটি এখন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠাপোষক রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেত্রী।
চলতি বছরের আগস্ট থেকে মূলত জাপায় গৃহবিবাদ শুরু হয়, যা একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ছাপিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত গড়ায়। আকস্মিকভাবেই ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিলের ডাক দেন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ। এ নিয়ে দলে তীব্র জটিলতার সৃষ্টি হয়। রওশনকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে বাদ দিতে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন জি এম কাদের। পরে সরকারের মধ্যস্থতায় রওশন সম্মেলন স্থগিত করলেও মূল সমস্যা থেকেই যায়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে রওশন, জি এম কাদের ও সাদ এরশাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এমনকি রওশন ও জিএম কাদের একসঙ্গে নাশতা করার পরও পরিস্থিতি বদলায়নি। সবশেষ রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দাওয়াত দিয়েছেন জিএম কাদের। শেষ পর্যন্ত সরকারের অনুরোধে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু গণমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ থাকবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। পার্টিতে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভেদ নেই। রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে তৃতীয় পক্ষ চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হবে না। আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চাই। অনেকটা একই কথা বলেন রওশনের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ গণমাধ্যমকে বলেন, সবকিছু ঘুচে যাবে একসঙ্গে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের মঞ্চে উঠলে। শীর্ষ নেতারা ঠিক থাকলে তৃণমূলের ধোঁয়াশা কেটে যাবে। তবে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জাপার নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা সময়ের আলোকে বলেন, মূলত আমাদের পার্টিতে দুটি ধারা অব্যাহত। একটা হচ্ছে দালাল টাইপ। আরেকটি দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। যখনই জাতীয় পার্টি দাঁড়াতে চায় তখনই ওই দালাল গ্রুপ পার্টির ভাঙনে উঠেপড়ে লাগে। দালাল গ্রুপ সব সময় মহাজোটের সঙ্গে থাকতে চায়; কারণ তারা জানে মহাজোটের সঙ্গে না থাকলে কখনোই এমপি হতে পারবে না। এ জন্য সরকার যাই বলুক তারা সেটাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
এদিকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে জি এম কাদেরের উপস্থিত থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ, তার বিরুদ্ধে দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে আদালতের আদেশ রয়েছে। বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তিনি দলীয় কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। তবে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ মনে করেন, উপনেতা হিসেবে জিএম কাদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন।
জানা গেছে, পার্টির বেশিরভাগ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও কাউন্সিল হয়নি। ৭৬টি সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে ৫০টির বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ। ৩৫টির বেশি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির নামে জেলা-উপজেলা কমিটি চলছে বছরের পর বছর। তিন বছরের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
সেনাপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা হারানোর পর ওই দশকেই দলে প্রথম ভাঙন ধরে। বর্তমানে জাপার সংসদ সদস্য ২৬ জন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাপার আসন ছিল ৩২টি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন পায় দলটি।
কর্মসূচি : কোন্দলের কারণে এ বছর তেমন আয়োজন নেই। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বেলা ৩টায় রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ হবে। পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপির সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ এমপি ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপির। এর আগে দুপুর ২টায় রাজধানীর মুক্তাঙ্গন (সচিবালয় সংলগ্ন) থেকে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হবে। শ্যামপুর-কদমতলী থানা জাতীয় পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি।