নূরের অতীত-বর্তমান

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৭:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

  অনলাইন সংস্করণ

রাষ্ট্রীয় সাবধানতায় ২০২১ এর মে মাসে ’আন্তর্জাতিক মান রক্ষার্থে’ বাংলাদেশের ই-পাসপোর্ট থেকে ’ইসরাইল ব্যতীত’ শব্দগুচ্ছ অপসারিত হয়েছে। তবে এমআরপিতে (মেশিন পাঠযোগ্য পাসপোর্ট) আগের মতোই শব্দবন্ধটি বহাল রয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইসরাইল ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়নি। অর্থাৎ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক পাতার কোনো সম্ভাবনা বাংলাদেশের নেই। সেই ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির নেকা ও মোসাদ সদস্য মেনদি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈঠকের কথা ছড়িয়ে পড়লে কয়েকদিন নীরব ছিলেন নূর। পরে নিরবতা ভেঙে স্বীকার করলেন, বৈঠক হয়েছে। উদ্ধত নূরের প্রশ্ন, তাতে কী হয়েছে? 

সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো, ‘ইহুদি নাসারাদে’র সর্বদা মুন্ডুপাত করা নুরুর এই বৈঠক নিয়ে অবশ্য দেশের সুশীল সমাজ চুপ। নিশ্চুপ বামাতি সাকি, মান্না আর জাতির বিএনপি জামাতী বিবেক জাফরুল্লাহ চৌধুরী। 

অর্থ–বুভুক্ষু, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো নূরের পক্ষে কিছুই অসাধ্য না। যারা নুরের পরিচিত তারা এটা বিলক্ষণ জানে। নুরের অতীত এরই সাক্ষ্য দেয়।  

কে এই নূর

নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র৷ তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলায়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের গণরুমে ওঠেন৷ ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ২৪ ঘণ্টাই উন্মুক্ত থাকতো। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত গণরুমে থেকে প্রথম বর্ষের প্রায় প্রতি রাতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম করতেন নুরুল হক। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে মুহসীন হলের ‘গেস্টরুমে’ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অকথ্য গালিগালাজ ও নির্যাতন করেছেন তিনি৷
 
২০১৭ সালে নুরুল হক নুর মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে (সরকার জহির রায়হান-মেহেদী হাসান সানী) উপসম্পাদক মনোনীত হন৷ নুর মেহেদী হাসান সানীর অনুসারী ছিলেন৷ সানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবিদ আল হাসানের অনুসারী ছিলেন৷ ক্যাম্পাসের তৎকালীন অপরাধজগতের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন সানী৷ আবিদ আল হাসানের গ্রামের বাড়ি বরিশালে হওয়ায় নুরুল হক নুর সানীর অনুসারী হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, যেহেতু তারও (নুর) গ্রামের বাড়ি বরিশালে৷ সানীর হয়ে নানা অপকর্ম করতেন নুর৷ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক অপরাধীদের সঙ্গে নুরের দহরম-মহরম ছিল৷
 
২০১৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে৷ একই সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সম্মেলন নিয়েও আলোচনা শুরু হয়৷ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স সম্মেলন ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন৷ ওই বছরের শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল৷ সোহাগ-জাকির ও হাসান-প্রিন্স এবং লিয়াকত শিকদার নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ সিন্ডিকেট তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সম্মেলন নির্বাচনের পরে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন৷ এক্ষেত্রে তারা কোটা সংস্কার ইস্যুকে ব্যবহার করেন।
 
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নুর

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে শুরু থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন ছাত্রলীগের তৎকালীন শীর্ষ নেতা সোহাগ-জাকির ও আবিদ-প্রিন্স৷ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসান আল মামুনের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গঠিত হয় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের সহযোগিতায়৷ এমনকি তাদের টাকাও দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির ও হাসান-প্রিন্স৷ হাসান আল মামুন পরিষদের আহ্বায়ক হন এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার হলের ছোট ভাই নুরুল হক নুরকেও যুগ্ম আহ্বায়ক করেন৷ নুর মুহসীন হলে বিতর্ক করতেন৷ তাই গণমাধ্যমে কোটা আন্দোলনের নানা বিষয়ে কথা বলা ও টকশোতে যাওয়া শুরু করেন তিনি।
 
কোটা আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত ৮ এপ্রিল ও তার পরের কয়েক দিনে আন্দোলনের মূল ভূমিকায় ছিলেন হাসান আল মামুন এবং সূর্যসেন হলের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মুহাম্মদ রাশেদ খান৷ রাশেদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জোরালো অভিযোগ আছে৷ কোটা আন্দোলনের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন ছিল৷ দল-মতনির্বিশেষে সবাই চাইছিলেন কোটা সংস্কার হোক৷ 

কিন্তু সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতারা বেঁকে বসে৷ কিন্তু ততক্ষণে হাসান আল মামুন, রাশেদ ও নুরুলদের ওপর ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে৷ পরিচিতমুখ হয়ে উঠে তারাও আর ছাত্রলীগের নেতাদের মানছিলেন না৷ 

এমন পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের  ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নুরুল হক নুরকে পেটান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা৷ এর মধ্য দিয়ে নুরুল হক নুর সামনে চলে আসেন৷ পরে ২০১৯ সালের মার্চে ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জেতার পর নুরই সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মূল নেতায় পরিণত হন৷
 
দল গঠন ও তারপর
 
ডাকসুর ভিপি হওয়ার পর নুরুল হক নুরের জীবন পাল্টে যায়৷ আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তার অ্যাক্সেস তৈরি করে দেয় ডাকসুর ভিপি পদ৷ ভিপি পদে থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কোনো কাজ না করে নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন নুর৷ ভিপি পদে থাকা অবস্থায় নিয়োগবাণিজ্য এবং কমিশন ও ঘুষ-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন তিনি৷ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নুরের কথোপকথনের দুটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়৷ সেই অডিও ক্লিপের একটিতে নুরকে এক ব্যক্তির কাছে একটি নির্মাণকাজের ঠিকাদারির ব্যাংক গ্যারান্টি করতে সহযোগিতা চাইতে শোনা যায়৷ ওই ঘটনায় নুর যে ব্যাখ্যা দেন, তা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না৷ ওই ঘটনায় নুর তার ভাবমূর্তি নিয়ে ব্যাকফুটে পড়ে যান৷ কিন্তু ওই মাসের ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনের কক্ষে নুর ও তার সহযোগীদের ওপর ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলার ফলে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায় এবং নুর 'পাবলিক সিমপ্যাথি' পেয়ে যান৷
 
ভিপি পদ থেকে সাবেক হওয়ার পর সেই 'পাবলিক সিমপ্যাথির' ওপর ভিত্তি করে নুরুল হক নুর রাজনৈতিক দল গঠন করে জাতীয় নেতা হওয়ার দিকে মনোযোগ দেন৷ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ও এজেন্টদের নেপথ্য সহযোগিতা এবং বিশেষত জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি একের পর এক সংগঠন খুলতে থাকেন৷ জাতীয় নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে নুরের সামনে প্রতিবন্ধকতা ছিলেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন৷ মামুনের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীর করা ধর্ষণ মামলাকে এক্ষেত্রে কাজে লাগান নুর৷ মামুনকে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক পদ থেকে সরিয়ে ওই পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় শিবিরপন্থী হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ রাশেদ খানকে৷ পরে নিজের বিভিন্ন যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দেওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মামুনকে নুর গ্রেপ্তার করান বলে আলোচনা আছে৷ মামুনকে নিয়ে জামায়াত-শিবিরের আপত্তি থাকায় নুর তাকে গ্রেপ্তার করান বলে তখন জানা গিয়েছিল৷
 
মামুন গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরই ২০২১ সালের অক্টোবরে গণঅধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন নুরুল হক নুর৷ মার্কিন দূতাবাসের পরামর্শে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়াকে ওই দলের আহ্বায়ক করা হয় আর নুর হন সদস্যসচিব৷ এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দলের জন্য চাঁদার নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেন নুর৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী, আওয়ামী লীগবিরোধী ব্যবসায়ী-পেশাজীবী এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি তাদের অর্থায়ন করতে থাকে৷ তবে বড় অঙ্কের টাকার বিষয়টি রেজা কিবরিয়া ও নুর এককভাবে দেখভাল করতে থাকেন৷ কোটি কোটি টাকার হিসাব নিয়ে অন্য নেতাদের অন্ধকারে রাখেন রেজা ও নুর৷ টাকা নিয়ে রেজা ও নুরের সঙ্গে অন্যদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়৷ 
 
একবার টাকা নিয়ে রেজা কিবরিয়াকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করায় গণঅধিকার পরিষদের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে অর্থ কমিটির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ এ ছাড়া কর্মসূচিসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্তও রেজা ও নুর এককভাবে নিতে থাকেন৷ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণঅধিকার পরিষদের পল্টনের জামান টাওয়ারের কার্যালয়ে রাশেদকে হেনস্তা করেন নুরের অনুসারীরা৷ এসবের পাশাপাশি গণঅধিকার পরিষদসহ নুরুল হক নুরের সংগঠনগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত৷ এর মধ্যে এক পক্ষ জামায়াত-শিবিরপন্থী, আরেক পক্ষ জামায়াত ভেঙে ২০২০ সালে গঠিত এবি পার্টিপন্থী৷ নুরুল হক নুরের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত যুব অধিকার পরিষদের নেতা তারেক রহমান ও রবিউল ইসলাম একসময় ছাত্রশিবিরের ক্যাডার ছিলেন বলে জানা গেছে।
 
নুরুল হক নুর প্রচণ্ড লোভী, একগুঁয়ে ও স্বার্থপর ব্যক্তি৷ নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এবং টাকার প্রতি লোভকে চরিতার্থ করতে তিনি রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন৷ 

ঢাকাস্থ দূতাবাসগুলোতেও তার নিয়মিত যাতায়াত৷ যদিও এক্ষেত্রেও নুর ও রেজা কিবরিয়া ছাড়া অন্য নেতারা তেমন কিছু জানেন না৷ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একটি অংশের সঙ্গে নুরুল হক নুর নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন৷ 

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গেও নুরের যোগাযোগ রয়েছে বলে তার দলেরই একাধিক নেতা জানিয়েছেন৷ আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তিনি৷ 

নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়মিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য দেন নুর৷ একান্ত আলাপচারিতায় নুরুল হক নুর বলেছেন, তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হতে চান৷ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৫০টি আসন তাকে ছেড়ে দিলে তিনি দলটির ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে রাজি৷ তবে গণঅধিকারের অন্য নেতাদের অনেকের এ বিষয়ে আপত্তি আছে৷
 
নুরুল হক নুরের ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে নুর নিজেও নিশ্চিত যে এককভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই৷ কিন্তু ডাকসুর ভিপি হওয়া ও পরে সরকারের সমালোচনা করে সাধারণ মানুষের কাছে কথিত গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা নুর তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত৷ মূলত রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারই এই মুহূর্তে ধুরন্ধর নুরুল হক নুরের মূল উদ্দেশ্য৷ তার কাছে রাজনৈতিক আদর্শ কোনো মুখ্য বিষয় নয়৷ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তিনি জামায়াত-শিবিরের হাত ধরতে যেমন রাজি, তেমনি বিএনপির কোলে উঠতেও তার আপত্তি নেই৷ 

আবার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের পা ধরতেও প্রস্তুত নুর৷ কিন্তু তার দলের রাশেদ-ফারুক-বিন ইয়ামিন মোল্লা-তারেক রহমান-আরিফুল ইসলাম-আবু হানিফসহ বেশ কয়েকজন চান, নুর জামায়াত-শিবিরের পক্ষেই থাকুক।

নূরের মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ, সেখানে নূর কাদের কাছে থেকে টাকা নেন
 
নুরুল হক নুরের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে৷ কেউ বলছেন, লোভী নুর মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন মূলত অর্থ সংগ্রহ করতে৷ কারও মত হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো 'ডিলের' উদ্দেশ্যেই এই সফর৷ কারও ধারণা, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে নুর মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন৷ আবার কারও কারও ধারণা, নুরুল হক নুর ইতিমধ্যেই বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন৷ তাই তিনি আর দেশে ফিরবেন না৷
 
নিষেধাজ্ঞা এবং রেজা কিবরিয়া ও নুরের ব্যবসা
 

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং রাজস্ব বিভাগ আলাদা আলাদাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর থেকেই রেজা কিবরিয়া ও নুরের ব্যবসায় জমজমাট হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে রেজা ও নূরদের ব্যবসার সম্পর্ক কী। সম্পর্ক আছে। নিষেধাজ্ঞার পর রেজা কিবরিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ব্যাপকভাবে। 

তিনি এসব মাধ্যমে এসে বলতে থাকেন, আরও নতুন নতুন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে নিষেধাজ্ঞা আসছে। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরে কর্মরত তাঁর একাধিক বন্ধু তাঁকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বলেও দাবি করেন রেজা। কারা নতুন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে যাচ্ছেন তার তালিকাও তিনি দেখেছেন বলে দাবি করতে থাকের রেজা। 

তাঁর এসব কথাবার্তায় অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কিছু সরকারি আমলা ভড়কে যান। তাঁরা রেজার দ্বারস্থ হন, তাঁদের নামটা আছে কিনা সে বিষয়টি জানতে। এদের কেউ কেউ রেজার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না করতে পেরে নূরের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে থাকেন।  রেজা এই খোঁজ নেওয়ার সেলামি হিসেবে ১০০ ডলার করে দাবি করেন। নূরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে থেকে ১০০ ডলার করে নেন। এভাবে বেশ কয়েক লাখ টাকা তারা বাগিয়ে নেন। 

একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, যারাই রেজা ও নুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সন্ধান চেয়েছেন তাদের সবাইকেই বলা হয়েছে, তাদের নাম নেই। আসলে রেজার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সোর্সই নেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বা কোথাও। এভাবে কিছু মানুষকে ভয় দেখিয়ে, বিভ্রান্ত করে ব্যবসায় ফেদেছিল রেজা-নূর চক্র। এখন রেজা ও নুরের ভন্ডামির বিষয়টি এসব ব্যক্তির কছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।  
 
নির্বাচন বাণিজ্য

নিষেধাজ্ঞার পরপর মার্কিন তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম থাকা নিয়ে বাণিজ্য চলার সময়ই রেজা ও নূর নতুন ব্যবসা ফাঁদে। সেটা হলো নির্বাচনের আগাম মনোনয়ন বাণিজ্য। রেজা ও নূর তাঁদের এবং সমমনা অনেকের মধ্যে এমন ধারনার জন্ম দেয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে দ্রুত একটি নির্বাচনও হবে। তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির  সঙ্গে একজোট হয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে , এবং তাতে বিজয় সুনিশ্চিত বলেও প্রচার চালাতে থাকে। তাদের এসব কথায় মোহিত হয়ে একাধিক ব্যক্তি মনোয়ননের জন্য তাদের দ্বারস্থ হন। তাদের মধ্যে নুরের গণ অধিকার পরিষদের মাঠ পর্যায়ের নেতারাই বেশি ছিল। এরা কেউ কেউ পাঁচ লাখ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত টাকা দিয়ে তাদের মনোনয়ন ‘নিশ্চিত’ করতে চায়। কেউ টাকা দেয় রেজা কিবরিয়াকে আবার কেউ কেউ নূরকে। এভাবে কয়েক কোটি টাকা তাদের দুজনের হাতে আসে। এবার শুরু হয় নতুন খেলা। টাকা নিয়ে রেজা ও নুরের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। একে উভয়ের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনে। দেখা গেছে, একই আসনের জন্য রেজা ও নূর দলের মনোনয়ন দিতে দুই ভিন্ন ব্যক্তির কাছে থেকে অর্থ নিয়েছেন। এখন দুই ব্যক্তি মিলে রেজা ও নুরকে মনোনয়নের তাগাদা দিলে দুজনকেই তারা মনোনীত বলে স্বীকৃতি দেন। তবে এসব অনাচার দলের নেতারা মেনে নেন নি। তাদের কেউ কেউ টাকা ফেরত চান। তখন নুর রেজার কাছে মনোনয়নের জন্য নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে চাপ দেন। কিন্তু রেজা এতে বেঁকে বসে নূরকেই টাকা ফেরত দিতে বলেন।

দেখা গেছে, মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতা স্থানীয় মানুষের কাছে ধার করেও অর্থ দিয়েছে। তারা পড়েছে মহা ফাঁপড়ে।
 
নুরুল হক নুরসহ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ে গঠিত গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া। ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর দলটির আহ্বায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা। এরইমধ্যে গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে রেজা কিবরিয়ার। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে দলত্যাগের দিকে যেতে পারে বলে গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর মূল কারণ অর্থ নিয়ে দুজনের দ্বন্দ্ব।

গণ অধিকার পরিষদের নেতারা প্রকাশ্যেই গণমাধ্যমকে বলেন,  রেজা কিবরিয়া দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে খুব একটা সক্রিয় হতে পারেননি। মাঠে ময়দানে কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি দিন দিন কমেছে। দলের তরুণ একটি অংশও রেজা কিবরিয়াকে ‘আহ্বায়ক’ হিসেবে চায় না। গত ১৫ নভেম্বর (২০২২) বিএনপির সঙ্গে সম্ভাব্য গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকের কথাও তাকে জানানো হয়নি।

গণ অধিকার পরিষদে যুক্ত একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দলের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরসহ তরুণ নেতারা মনে করছেন, রেজা কিবরিয়া দলে যুক্ত হওয়ার পর গণমাধ্যমের কাভারেজে পিছিয়ে পড়েছেন তরুণ নেতারা। আর একইসঙ্গে রেজা কিবরিয়ার নিজেরও এই দলে কাজ করার সুযোগ কমেছে। টাকা-পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্বরে পাশাপাশি এসব কারণে উভয়পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

গণ অধিকার পরিষদের এক নেতা গণমাধ্যমে বলেন, ‘গণ অধিকার পরিষদের ইয়ংদের একটি গ্রুপ রেজা কিবরিয়াকে দলে চায় না।’

সরকার-বিরোধী শুদ্ধ রাজনীতির ধ্বজাধারী রেজা ও নুরের নোংরামি, অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। নূরের কাছে এসব অর্থের হিস্যা চেয়ে একাধিক নেতা গত নভেম্বর মাসেই একাধিকবার কথা বলেন। তবে এসব প্রশ্ন তোলাকে ভালভাবে নেননি নূর। উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হাতাহাতির পর্যায়েও পৌঁছে যায়।

১০ ডিসেম্বর ঘিরে আশা ধূলিসাৎ

রেজা কিবরিয়াসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে টাকা পয়সার ভাগ-বাটোয়ারি নিয়ে যখন প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চলছে, এরই মধ্যে ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির  বিভাগীয় সমাবেশ। বিএনপির নেতারা হম্বিতম্বি করতে শুরু করেন, এ দিনই সরকার পড়ে যাবে। এতে হালে পানি পায় নূর। সরকার পড়ে যাচ্ছে, এমন আশায় উদগ্রীব নূর মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও দ্রুত দেশে চলে আসে। তখন নূর মধ্যপ্রাচ্যে টাকা তুলতে ব্যস্ত থাকার মিশনে থাকলেও দ্রুত চলে আসেন সরকারে ‘হিস্যা’ নেওয়ার জন্য। 

কিন্তু ১০ ডিসেম্বরে নূর-বিএনপি-জামায়া-অতিবাম সাকিদের প্রত্যাশা ধুলিসাৎ হলো। এরা সবাই ভেবেছিল, ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের আগেই মার্কিন সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বড় ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে। তাতে সরকারের অবস্থা টালমাটাল হয়ে যাবে। আর গুড় থাকে নূর-বিএনপি-জামাত-সাকি মিয়ারা। কিন্তু রাজনীতির ন্যূনতম পাঠহীন এসব ব্যক্তি না দেশের রাজনীতি না বৈশ্বিক রাজনীত্—কোনো বিষয়ই ঠাহর করতে পারে না। ১০ ডিসেম্বরের আশা শেষ হয়ে যাওয়ায় নূর আবার মধ্যপ্রাচ্যে ভিক্ষায় ব্যস্ত।