হাইকোর্টের রায়ের আলোকে নির্বাচন কমিশন ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল’ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছিল ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার ও নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরেও এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে ‘বিএনপি লাভবান হবে নাকি আওয়ামী লীগ, সেই হিসাব-নিকাশ এখনও চলছে ক্ষমতাসীন দলটির মধ্যে। এ কারণে জামায়াতের চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলেও দলটিকে নিষিদ্ধের উদ্যোগ থেকে সরে এসেছে সরকার।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিষ্কার জানিয়েছেন, জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু করবে না।
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের স্বাধীনতায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যদি কোনো সংগঠন, (ক) নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, (গ) রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় এবং (ঘ) সংগঠনের গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থি হয় তবে সমিতি বা সংগঠন করার অধিকার তাদের থাকবে না। আইনবিদরা জানিয়েছেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের আলোকেই নিষিদ্ধ হতে পারে জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিবাদী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। এ জন্য নতুন কোনো আইন প্রণয়ন বা আদালতের কোনো রায়েরও প্রয়োজন নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের অব্যাহত নৈরাজ্যজনক তা-ব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নেওয়াসহ রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে সরকার সাংবিধানিকভাবেই উগ্রপন্থি দলগুলোকে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে পারে।
আইনবিদ ও মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ জানান, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে দেশের মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কোনো জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। এটা করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় চাইলেই নির্বাহী আদেশ জারি করে তাদের কর্মকা- নিষিদ্ধ করতে পারে। এ জন্য আদালত বা সংসদের দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই নতুন আইন প্রণয়নেরও।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের চলতি মেয়াদেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে একেবারেই অনাগ্রহী সরকার।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে দলটির নেতারা বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে চলে যেতে পারেন। তাছাড়া জামায়াত নিষিদ্ধ হলে দেশের ভেতরে কোনো বৈরি পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেখা গেছে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই তখন বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়বে। ফলে বিএনপির শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এসব কারণে নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি বলেই মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। তাই জামায়াত নিষিদ্ধ করতে আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সরকার। আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ করে উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াত নিষিদ্ধ করার কার্যক্রম ধীরগতিতে চললেও সরকার মনে করছে, তখন বিষয়টি পাকাপোক্ত হবে।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, নির্বাহী আদেশে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার কথা সরকার ভাবছে না বলেই কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আইন সংশোধনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আদালতে রয়েছে। তাই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। স্বপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেই।
যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেই পদক্ষেপ থেকে সরে আসা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর পেছনে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনো সমঝোতা নয়, যেহেতু বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন, তাই ভিন্ন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ যুক্তিসঙ্গত নয় বলেই বিষয়টি থেমে আছে।
প্রসঙ্গত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। তবে কেউই জয়ী হতে পারেননি।