কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনের সুযোগ পেল ঢাকা

ব্যস্ততায় সময় কাটছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শামীম সিদ্দিকী

অল্প সময়ের ধারাবাহিকতায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এসব সফরের কার্যসূচি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে তাদের অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হচ্ছে। এই তিন সফরের সাফল্য ঘরে তুলতে পারলে, বাংলাদেশ কূটনৈতিক অঙ্গনে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।

আজ ঢাকা সফরে আসছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আর আগামী ১০ সেপ্টেম্বর আসবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর ফাঁকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফরে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। সেখানে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করবেন। পরের দিন যোগ দেবেন নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে। অল্প সময়ের মধ্যে ধারাবাহিক উচ্চপর্যায়ের এসব সফরের কর্মসূচি সামাল দিতে কূটনীতিকদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ আজ দুই দিনের সফরে ঢাকা আসছেন। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক অঙ্গনে নানা পর্যালোচনা চলছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রবল চাপের মুখে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার উপর নানা ধরনের অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এই অবস্থার মধ্যেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসছেন। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে রাশিয়া। এছাড়া রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যশস্য ইত্যাদি আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। তবে রাশিয়ার অনেক জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম আনতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে মস্কোর পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপন করা হতে পারে।

এছাড়া ইউক্রেনযুদ্ধ ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে পশ্চিমাদের চাপের মুখে থাকায় এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সক্রিয় সমর্থন চাইতে পারেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানিয়েছেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সফরকালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরো বিকাশের সম্ভাবনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করা হবে। একই সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতবিনিময়ের পরিকল্পনাও রয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যেসব জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পর থেকে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা রাশিয়াকে একটি অনুরোধ করতে পারি- দ্রুত যেন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা যায়।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সক্রিয় সমর্থন, খাদ্য, সার ও জ্বালানির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, আমাদের যে সমস্যা আছে, আমরা তা তুলে ধরব। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রাশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থনের মাধ্যমে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছরের মধ্যেও রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসেননি। সেদিক থেকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন শেষে জাকার্তা থেকে ঢাকায় আসবেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একদিন অবস্থানের পর তিনি ঢাকা থেকে দিল্লি যাবেন। গত বছরের নভেম্বরে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোট- আইওআরএ’র মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা ছিল রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। তবে হঠাৎ করেই ওই সফর বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে পুনরায় এই সফর নির্ধারিত হয়।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আগামী ১০ সেপ্টেম্বর দ্বিপাক্ষিক সফরে বাংলাদেশে আসছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাবেন। সফরকালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে বাংলাদেশের জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে ম্যাক্রোঁ’র শীর্ষ বৈঠকের কথা রয়েছে। এছাড়া ফরাসি প্রেসিডেন্টের সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত তার কার্যালয়ে (পিএমও) একটি ভোজসভায়ও ম্যাক্রোঁ’র যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করবেন বলেও আশা করা হচ্ছে। এরপর তাদের একটি যৌথ প্রেস বিফ্রিংয়ের আয়োজনের কথা রয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথে থাকবেন দেশটির ইউরোপ এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনা।

বিমানবন্দরে ম্যাক্রোঁকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে দুই দেশের সরকার আন্তরিকভাবে আশা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ফ্রান্স সফর করেন। এদিকে আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করবেন। জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভসহ বিশ্ব নেতারা। জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের পাশাপাশি আগামীকাল ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কেন না, স্বাধীনতার পর রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশে এটিই প্রথম সফর। আর ৩০ বছর পর ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসছেন। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ফ্রান্স পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও এই দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ কূটনৈতিক অঙ্গনে একটা ভারসাম্য অবস্থানে রয়েছে। এটা কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কম অর্জন নয়। কাছাকাছি সময়ে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সফর ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন কূটনৈতিকরা।