দীঘা সৈকত পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন সমুদ্রের ঢেউ দেখছি, তখন কানে ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান। প্রথমে ভেবেছি এখানকার কোনো দোকানে চলছে, বা আশপাশের কেউ মোবাইলে রবীন্দ্রসংগীত শুনছেন। কিন্তু না, এখানকার পুরো সৈকত পাড় জুড়েই এ গান চলছে। আর এটা চালাচ্ছে এখানকার কর্তৃপক্ষ। মূলত সৈকতে আসা পর্যটকদের বাড়তি আনন্দ দিতেই এ গান চালানো হয়। এ ছাড়া গানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে সচেতনতামূলত প্রচারণাও করা হয়। যেমন- সৈকতে প্লাস্টিক বর্জন, পরিবেশ সুরক্ষায় করণীয়, ভাটার সময় পানিতে না নামা ইত্যাদি।
দিনভর দীঘায় থাকার ইচ্ছে নিয়ে দুপুরের আগেই দীঘা পৌঁছি। ভ্রমণসঙ্গী সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ। খুব সকালে হাওড়া রেলস্টেশন থেকে উঠি তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার মাথায় নামি দীঘা স্টেশনে। স্টেশন থেকে একটু হাঁটলেই দেখা মেলে নতুন দীঘা সৈকত।
মার্চের মাঝামাঝি হওয়ায় পর্যটকের ভিড় একটু কম। তাই একটু নিরিবিলিই মনে হচ্ছে। সৈকত পাড়ে এসে চারপাশটা একনজর চোখ বুলিয়ে নিই। এরপর বসি একটি রেস্টুরেন্টে। দুপুরের খাবার অর্ডার করি। রূপচাঁদা মাছ, সঙ্গে সাদা ভাত, ডাল, সবজি, আচার, পাঁপড়। স্বাদ ভালোই। এর পর আসি সৈকত পাড়ে।
দীঘা সৈকতের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। কলকাতা শহর থেকে এর দূরত্ব ১৮৭ কিলোমিটার। ৭ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এ সৈকত। প্রায় পুরো সৈকত পাড় মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো। বাঁধের পর দেওয়া আছে বড় বড় পাথর। এ পাথর পার হলেই সৈকত।
অসংখ্য পর্যটক সৈকতে গোসল করছেন। অনেকে বাঁধের উপর বসে সৈকত দেখছেন। আবার কেউ কেউ পাথরের ওপর বসে সৈকত দেখছেন। সৈকতে ওয়াটার বাইকে অনেকে এদিক-সেদিক ঘুরছেন। আর সৈকত পাড়ে থাকা ঘোড়ার পিঠে করে অনেকে এদিক-সেদিক ছুটছেন। মূলত সৈকত এলাকা যেমনটা হয়, তেমনি এ সৈকতও।
আমি আর আসাদ ভাই পাথরের উপর বসি। ভালো লাগছে পুরো সৈকত পাড় বাঁধ দেওয়া দেখে। বাঁধের বাইরে কোনো দোকান, স্টল বা স্থাপনা নেই। পর্যটকদের সচেতন করতে মাইকে বারবার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিচ্ছেন। ফলে সৈকত এলাকা বেশ পচ্ছিন্ন ও পরিবেশবান্ধব।
পাথরে বসে-দাঁড়িয়ে আসাদ ভাই রীতিমতো ফটোসেশন করছেন। মেঘের নতুন টি-শার্ট দিয়ে তিনি এ ফটোশেসন করছেন। আর ফটোগ্রাফার আমি। দারুণ সব ছবি হলো আসাদ ভাইয়ের। ছবি তোলা হলে আমরা সৈকত পাড়ের বাঁধ বা মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে শুরু করি নতুন দীঘা থেকে পুরোনো দীঘার দিকে। এ পথেও পর্যটকদের চলাফেরা কম। ডানে সমুদ্র, বামে ঝাউবন, মাঝের পথ ধরে হাঁটছি আমরা। কিছুটা আসার পর একটা চায়ের দোকান দেখি। আর চায়ের দোকান দেখে এককাপ চা খাব না? সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী মিলে দোকনটি চালাচ্ছেন। এক কাপ চা অর্ডার করাতে দোকানি পানি, দুধ, চিনি, চা চুলায় দিলেন। অল্প সময়ে চা তৈরি হলো। দিল মাটির কাপে। দাম ১০ রুপি। সৈকত পাড়ে বসে চা খাওয়ার এ সময়টুকুু বেশ ভালো লাগল। এরপর আবার হাঁটা শুরু করি। একটু হাঁটতেই দেখি সৈকতঘেঁষা একটি মন্দির। এর পর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসি পুরোনো দীঘা। মূলত পুরোনো দীঘার সৈকতই এক সময় জমজমাট ছিল। দীঘার মূল শহরও এ অংশে। এখানে থাকার অনেক হোটেলও আছে। নতুন দীঘায় অনেক হোটেল থাকলেও বা জমজমাট হলেও পুরাতন দীঘায়ও ভিড় কম থাকে না। পুরোনো দীঘায় কিছুটা সময় কাটিয়ে অটোতে আসি রেলস্টেশন। অটোতে আসার পথে দেখি বিশাল এলাকা জুড়ে হচ্ছে দীঘা জগন্নাথধাম। স্টেশনে এসে দেখি কোনো লোকজন নেই। আসলে অল্প কিছু ট্রেন দীঘা আসে-যায়। ফলে সময়ের বাইরে স্টেশনটি অনেকটা ফাঁকাই থাকে। তবে স্টেশনটি সুন্দর। লাউঞ্জের দেওয়ালে ভারতের বিখ্যাত অনেকের ম্যুরাল রয়েছে। আরও অনেক শিল্পকর্মও আছে। সব মিলিয়ে সুন্দর। কিছুক্ষণ লাউঞ্জের চেয়ারে বিশ্রাম নিয়ে ফিরি নতুন সৈকতে।
সৈকত পাড়ে কয়েকজন নারী ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছেন। আমরা ডাব খাই। দাম ৪০ রুপি। এর পর খাই এখানকার স্পেশাল কুলফি আইসক্রিম। দাম ১০ রুপি। এর পর এসে বসি সৈকতের পাথরে। মাইকে ওতখনও রবীন্দ্রসংগীত চলছে। এর মধ্যে বিকেলও হয়ে এলো। সব মিলিয়ে দারুণ পরিবেশ। এ ছাড়া আসাদ ভাই দীঘায় আসার পর থেকেই গুনগুন করে মৌসুমি ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি...’ গাইছিলেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকি সৈকত পাড়ে। এরপর আসি স্টেশনে। অপেক্ষা করি ট্রেন কান্ডারি এক্সপ্রেসের জন্য।