আগামী দিনের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগে নবীন উদ্যোক্তাদের ‘স্টার্টআপ’ ধারনাকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ করপোরেট ফোরামের সভাপতি জিএম কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে শুধু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে নজর দিলে হবে না। কটেজ থেকে শুরু করে মাইক্রো, স্মল, যেটা সিএমস, সবাইকে নিয়ে সামনে আগাতে হবে। পাশাপাশি একটা ল্যাপটপ দিয়ে শুরু করা ফ্রিল্যান্সারের কাছে যে স্টার্টআপ ধারনা আছে সেটাকে এগিয়ে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। যারা সিনিয়র আছেন, তাদের পাশাপাশি সফল শিল্পোদ্যোক্তারাও স্টার্টআপ পর্যায়ে তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবসায়ে করপোরেট ধারণা প্রচলনে যে ক’জন মানুষ কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে জিএম কামরুল হাসান অন্যতম। আব্দুল মোনেম গ্রুপের ইগলু আইসক্রিমের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সবার কাছে সুপরিচিত তিনি। ফিয়োনা নামে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে আছেন তিনি। যারা নতুন কিছু করতে চান, ক্যারিয়ারে কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে, সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে গড়ে তুলছেন, করপোরেটকোচ নামে ভিন্নধর্মী একটি প্ল্যাটফর্ম।
দেশের করপোরেট জগতে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থাকা কামরুল স্বপ্ন দেখেন নবীন উদ্যোক্তাদের নিয়ে, যারা দেশের জন্য কিছু করতে চান, অবদান রাখতে চান আগামীর অর্থনীতিতে। তার মতে, বর্তমান সময়ে উদ্যোক্তা হতে যতটা না পুঁজি দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার মানসিক শক্তি। ব্যবসায় হালাল উপার্জনের পরিকল্পনা ও ধৈর্য। আমাদের দেশে অনেকেই স্টার্টআপ করেন প্রতিযোগিতায় ও সেমিনারে অংশ নেয়ার জন্য। এখান থেকে বের হতে হবে। বছর অনুযায়ী পরিকল্পনা থাকতে হবে, আমি কোথায় যেতে চাই।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাবের) সঙ্গে সম্পৃক্ত কামরুলের দাবি, ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে অনেক উন্নয়ন সামনে থাকলেও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনীহা রয়েছে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। তিনি বলেন, এখানে (প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ অর্থায়নে) কাজ করার সুযোগ আছে। সিনিয়র যারা আছেন, তাদের উচিত নবীন উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা। সরকার, আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে ভাবতে হবে নতুনদের নিয়ে।
স্টার্টআপ হচ্ছে এমন কোনো নতুন উদ্যোগ, যারা একেবারেই নতুন ধরনের পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে কাজ করে। যে পণ্য বা পরিষেবার বাজার আছে এবং যার বিকল্প নেই।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির মাধ্যমে নবীন উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিএসআরের মাধ্যমে যে কাজ হয় সেখানে সাস্টেইনিবলিটি কম থাকে। মূল উদ্দেশ্যের জায়গা থেকে সরে এসে আমরা শুধু ‘ছবি তোলা’ ও মিডিয়ায় প্রকাশে বেশি জোর দিচ্ছি। শুধু কম্বল দেয়াটা সিএসআর নয়। অসহায় রোগীর চিকিৎসাও অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এমন প্রকল্প, যেমন স্টার্টআপ গঠনে অর্থায়নও সিএসআর হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়নে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে নেসলের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে ক্যারিয়ারে আর পেছনে তাকাতে হয়নি কামরুলের। পরবর্তী সময়ে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেন। নব্বই দশকে মার্কেটিংয়ে শুরু করে প্রধান নির্বাহী পর্যায়ে চলে এসেছেন তিনি। ফিওনার প্রতিষ্ঠাতা কামরুল হাসান বলেন, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য যারা উদ্যোক্তা হতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য কোনো সহযোগিতা আমি দেখছি না। শুধু বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে মিলিনিয়ার বানালেই হবে না। উদ্যোক্তাদের কৌশল, বিজনেস মডেল অনুযায়ী তাদের অর্থায়ন করতে হবে বিনা সুদে। ‘এ উদ্যোক্তারাই মুনফায় গেলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশি কর দেবে। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা তৈরির পড়াশোনা হচ্ছে না। তারা শুধু পড়ায়, কিন্তু তাদের সঙ্গে শিল্পের কোনো সংযোগ নেই। তারা পুঁথিগত বিদ্যা প্রদান করছে, যার সঙ্গে অর্থনীতির সামঞ্জস্য করা কষ্টকর।’
স্টার্টআপদের অর্থায়নে আবারও জোর দিয়ে কামরুল বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে কটেজ, মাইক্রো স্মল ইন্ডাস্ট্রির ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি অলস পড়ে আছে। ব্যাংকগুলো এ অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না। যদি ১০ লাখ টাকা করে ইকমার্স কিংবা সার্ভিস সেক্টরের কোনো উদ্যোক্তাকে অর্থায়ন করা যায়, তবে ১০০ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব, যারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে। যেখানে আধিপত্য থাকবে ই-কমার্সের। কামরুলের পরামর্শ, যারা দেশের প্রতি দায়িত্বশীল, তরুণদের প্রতি দায়িত্বশীল, দেশের জন্য কিছু করতে চায়, এ গ্রুপটাকে নিয়ে সরকারের একটি ফোরাম করে দেওয়া উচিত। ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নজরকে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ে যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, সার্ভিস সেক্টরে, যেখানে ঝুঁকি কম, সেখানে অর্থায়ন করে তাদের এগিয়ে নিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি, যাকে কমিউনিটি ইকোনমি বলি আমরা, সেখানে যদি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যায় তবে রাজধানীর ভিড় কমবে অনেকাংশে।
সম্প্রতি ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কামরুল হাসান। যেখানে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করার প্রক্রিয়া নিজেকে যুক্ত করেছেন নিজের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে। ই-ক্যাবের একজন সদস্য হিসেবে দেশের ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে অবদান রাখতে চান তিনি। ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, এ জায়গাটিতে আমি ভালোভাবে অবদান রাখতে চাই। প্রতি মাসে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে নতুন যদি কেউ উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের আমি সাহায্য করব, একদম স্বপ্রোণোদিত হয়ে। যদি আমার মাধ্যমে ১০০ জন উদ্যোক্তা তৈরি হয় তবে আমি মনে করব সমাজের প্রতি আমি কিছু করতে পেরেছি।
করপোরেট কোচের প্রতিষ্ঠাতা উল্লেখ করেন, করোনাকালে আমি প্রায় ২০০০ জনকে অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে পরামর্শ দিয়েছি, উদ্যোক্তা হওয়ার প্রক্রিয়া, জীবনে সফল হতে হলে কি করতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, জীবনে সফল হতে হলে, কাউকে না কাউকে উপদেষ্টা হিসেবে মানতে হবে। বাংলাদেশ করপোরেট ফোরামের সভাপতি হিসেবে আমার আরেকটা স্বপ্ন আছে। কর্মী ও প্রতিষ্ঠানকে একই সুতোয় গাঁথা। করপোরেট শব্দটি কাছাকাছি শব্দ হলো কো-অপারেট। মানে সবাই মিলে যেকোনো কাজকে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় যারা থাকেন, তাদের মধ্যে একটা মানসিক দূরত্ব কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের দাস মনে করি।
নতুন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করপোরেটের সংযোগ কীভাবে হবে- এ প্রশ্নে কামরুল মনে করেন, এটা খুব সহজেই সম্ভব। শুধু শুরুটা প্রয়োজন। আমি কাউকে মটিভেট করার জায়গায় নেই। আমার কথা একদম র্যাশনাল। একদম সহজে যদি বলি, প্রথম পেরেকটা ঠুকতে যতটা কষ্ট, পরে হাজারটা সহজ হয়ে যায়। প্রথমে কেইস আইডেন্টিফাই করতে হবে। আমরা একসঙ্গে এগোতে চাই। বিভিন্ন সেক্টর থেকে প্রতিনিধিত্ব চাই।
কর্মক্ষেত্রে নতুনদের নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কতটা দেশপ্রেমের পরিচয় দিচ্ছেন। শুধু ব্যবসা করলে হবে না, দিন শেষে তাদের সমাজের কাছে ফিরে যেতে হবে। সমাজে তাদের অবদান কতটুকু, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।