গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি। এ চিত্তাকর্ষক বৃদ্ধি, একটি ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত, বর্ধিত বিদেশি বিনিয়োগসহ নানা বিষয় জড়িত। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন। এর শুরু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে। ঘোষণায় বলা হয়, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ পরিণত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে। সেই লক্ষ্যে এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি সেবাগুলোকে আরও সহজলভ্য ও দক্ষ করে তোলার মাধ্যমে সেবা প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করা এবং আমলাতন্ত্রের জটিলতা কমানোর কাজ শুরু করে। এরপর থেকে সরকার কর সংগ্রহ, পাসপোর্ট ও ভিসা প্রদান, জমি নিবন্ধন ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন জনসেবাকে ডিজিটালাইজ করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
ডিজিটাইজেশনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো এটি নাগরিকদের নানা সুবিধা দেয়। জনসাধারণকে আর সরকারি সেবা পেতে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে বা সরকারি অফিসে একাধিক যাতায়াতে সময় ব্যয় করতে হয় না। এর পরিবর্তে নাগরিকরা বিভিন্ন সরকারি পোর্টাল ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে সেবাগুলো পেতে পারেন। এতে সময় বেঁচে যাচ্ছে ও সরকারি অফিসে যাতায়াতের ঝক্কি-ঝামেলা কমে গেছে ও দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। বিশেষ করে প্রান্তিক লোকদের বেলায় ডিজিটালাইজেশন সেবা বেশি কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া ডিজিটালাইজেশন সাধারণ মানুষের সরকারি সেবা গ্রহণের খরচও কমিয়েছে। আগে যাতায়াত, নথি ফটোকপি ও সরকারি সেবা প্রাপ্তির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যয়ের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হতো। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অধিকাংশ সেবা অনলাইনে পাওয়া যায়, ফলে এ সংশ্লিষ্ট খরচ কমেছে।
ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এটুআই ৩১৬টি এজেন্সি এবং ৩৭টি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত ২০৮৭টি ডিজিটাল সেবাগুলোতে সময়, খরচ ও যাতায়াত গণনা করেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো দ্বারা প্রদত্ত ২০৮৭টি অনন্য ডিজিটাল সেবা থেকে ৫.৮ বিলিয়নেরও বেশি মোট সেবা সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রচেষ্টার কারণে সেবা গ্রহীতারা ১৯ বিলিয়ন দিন, ২১.৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ এবং ১২.৭ বিলিয়ন যাতায়াত-শ্রম বাঁচিয়েছে। প্রাক-ডিজিটালাইজেশন অবস্থার তুলনায়, সরকারের বিদ্যমান ডিজিটালাইজেশন এবং সেবা সহজিকরণ প্রচেষ্টা ৭৩ শতাংশ সময়ে, খরচে ৬৯ শতাংশ এবং সেবাগ্রহীতার যাতায়াত সংখ্যা ৮৫ শতাংশ সাশ্রয় করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশনের একটি প্রধান প্রক্রিয়া হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। ম্যানুয়াল প্রক্রিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয় করে এবং কাগজপত্র কমিয়ে, ডিজিটালাইজেশন সরকারি সেবাগুলো সহজ ও দ্রুততর করেছে, যা তাদের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করেছে এবং ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। ডিজিটালাইজেশন ব্যবসা করার সময় এবং খরচ কমাতে সাহায্য করেছে, যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পরবর্তী সময়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। দেশে সুশাসন ব্যবস্থার উন্নতি ও দুর্নীতি কমাতেও সাহায্য করেছে। সরকারি সেবাগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার মাধ্যমে, ডিজিটালাইজেশন দুর্নীতির সুযোগ কমাতে এবং জনসেবা প্রদানের উন্নতিতে সাহায্য করেছে। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি করতে সাহায্য করেছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আরও অবদান রেখেছে।
লক্ষণীয় যে, দেশে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগণের ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো- পাবলিক সার্ভিসের ডিজিটালাইজেশনে ডেটার গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাইবার হুমকি থেকে ব্যক্তিগত ডেটা রক্ষা করা এবং ডিজিটাল সিস্টেমগুলো সুরক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন এবং দেশকে দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে তা সাহায্য করেছে। সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন থেকে প্রাপ্ত লাভ ধরে রাখতে, বাংলাদেশকে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে এবং সারা দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে। ডিজিটাল সেবা সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা যাতে সমাজে সুষ্ঠুভাবে মানুষ পেতে পারেন সেজন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সেবা তৈরিতে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিশ্ব যেভাবে আরও ডিজিটাল হয়ে উঠছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভবিষ্যতে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী পন্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনসেবাকে আরও দক্ষ ও মান-সম্মত করবে, যা আরও টেকসই ডিজিটাল অর্থনীতি তৈরি করতে সহায়তা করবে।
বলা যায়, দেশে সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন একটি গেমণ্ডচেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জিডিপি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে এবং দেশকে একটি প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তর করেছে। এখনও মোকাবিলা করার অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অগ্রগতির প্রক্রিয়া চলমান থাকতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের এই ডিজিটাল রূপান্তরকে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবনের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন, ক্রমাগত বিনিয়োগ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে তার কাক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : ডাটা সমন্বয় কর্মকর্ত
এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআই