ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হাতে-কলমে পদার্থ বিজ্ঞান শেখান ফরিদুল!

মুখস্থ নয়
হাতে-কলমে পদার্থ বিজ্ঞান শেখান ফরিদুল!

গ্রামের নাম কুপা। বগুড়া থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জ উপজেলার দাড়িদহ বাজারের খুব কাছেই অবস্থিত। এ গ্রামে বসেই পদার্থ বিজ্ঞানের মতো রসকসহীন একটি বিষয়ের উপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ফরিদুল ইসলাম। এ কাজটি করতে গিয়ে বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ল্যাব। নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান তিনি শেখান বিনামূল্যে। ফরিদুলের ল্যাবে বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে প্রায় ২০০ ছাত্রছাত্রী বিনা খরচে শিখছেন পদার্থ বিজ্ঞান। মুখস্থ না করিয়ে নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান ফরিদুল শেখাচ্ছেন ডিভাইসের মাধ্যমে। তার এ উদ্যোগের কল্যাণে আশপাশের বিদ্যালয়গুলোয় নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা খুব সহজেই পদার্থ বিজ্ঞান শিখতে পারছেন। স্কুলে পড়ার সময় যা শিখতে পারেননি তাই হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন ফরিদুল। স্কুলে পড়ার সময়ই তার সরল মনে রেখাপাত করেছিল পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো। ফরিদুল শিক্ষকদের নিকট জানতে চেয়েছিলেন সূত্রগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ। সীমাবদ্ধতা কিংবা সরঞ্জমাদির অভাবেই হোক শিক্ষকরা সূত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখাতে পারেননি। ফরিদুলের কিশোর মনে এটা প্রভাব ফেলেছিল। তার ধারণা, স্কুল পরিবর্তন করলে হয়তো তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ শিখতে পারবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি! স্কুল পরিবর্তন করেও লাভ হয়নি। শিক্ষকরা বারবারই পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। ফরিদুলের তাতে পদার্থ বিজ্ঞান সমন্ধে জানার আগ্রহ কমেনি বরং বেড়েছে। সেই আগ্রহ এতটাই যে ফরিদুল শ্রেণিকক্ষের পড়া ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে বসেই পদার্থ বিজ্ঞান ঘাটতে লাগলেন। এজন্য তাকে মা-বাবার বকুনিও কম খেতে হয়নি! যার মনে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে এত প্রেম তাকে থামায় কে! ফরিদুলও থামেননি। টিফিনের টাকা জমিয়ে কিছু ডিভাইস কিনে নিজের মতো করে শুরু করেন গবেষণা। মাঝে এলোমেলোভাবে এগিয়েছে পড়াশোনা। একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে ফরিদুলের মন ছিল গবেষণায়। পরিবারের ভয়ে কখনো বিজ্ঞান আবার কখনো মানবিক বিভাগে তাকে পড়তে হয়েছে। একাডেমিক পড়াই যে সবকিছু নয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ফরিদুল। কিশোর বয়সে পদার্থ বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো শিক্ষকরা ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে দেখাতে পারেননি সে সূত্রগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেন ফরিদুল। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ২০০০ সালে নিজ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন ইজি ইনডাকশন ল্যাব। শুরুতে ডিভাইস সংখ্যা কম থাকলেও এখন সেটি পরিপূর্ণ একটি ল্যাব। ইজি ইনডাকশন ল্যাবে বসে কথা হয় ফরিদুলের সঙ্গে। পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে কখন থেকে আগ্রহ তৈরি হলো জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সপ্তমণ্ডঅষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিজ্ঞান বইয়ে কিছু কিছু ডিভাইসের ছবি এবং এর ব্যাখ্যাও দেওয়া থাকত। তখন আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করতাম, স্যার যে ছবি দেয়া আছে এই জিনিসটা বাস্তবে দেখতে চাই। স্যারদের অনেকেই বলতেন এসব আসলে কাল্পনিক, ছবিগুলো বোঝানোর জন্য দেয়া হয়েছে, বাস্তব নয়। তারপর আমার পারিবারিক এবং মায়ের ইচ্ছায় মাদ্রাসায় ভর্তি হই। মাদ্রাসায় আমি যখন নবম শ্রেণিতে উঠি তখন বিজ্ঞান বইয়ে বিদ্যুৎ সমন্ধে আলোচনা ছিল। সেই অধ্যায় পড়ার সময় আমি শ্রেণি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার, এই জিনিসগুলো বাস্তবে দেখা যায় কীভাবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এখানে ল্যাব নেই, এগুলো শিখতে হলে তোমাকে হাইস্কুলে পড়তে হবে। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর হাইস্কুলে আবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই বিজ্ঞানটা ভালোভাবে শেখার জন্য। আমার আগ্রহ ছিল আমি ডিভাইস বাস্তবে দেখতে চাই, ডিভাইসগুলো কীভাবে কাজ করে তা দেখতে চাই। হাইস্কুলের স্যারকেও একই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা তো ছোট ক্লাস, এখানে তুমি এগুলো পাবে না, কলেজে গেলে এসব দেখতে পারবে। তখন আমার ভেতরে খটকা লাগে, আসলেও কি তাই? এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল, কোথায়ও গিয়ে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না। তখন আমার সন্দেহ হলো আমাদের দেশে মনে হয় এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। তখন আমি চিন্তা করলাম আচ্ছা, আমি নিজেই একটু চেষ্টা করে দেখি! এরপর আমি নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে শুরু করলাম। এরপর ফরিদুল না থেমে বলছিলেন, মহাস্থান মাহিসাওয়ার ডিগ্রি কলেজে আমি উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। আমি ভাবলাম এখানে প্র্যাকটিক্যালের সময় বেশ কিছু ডিভাইস দেখতে পারব। কিন্তু এখানে প্র্যাকটিক্যাল হয় না, পরীক্ষার আগে শুধু গতানুগতিক পাস করার জন্য, আমি যেভাবে চাই সেভাবে নয়। আর এখানে একটা বিষয় না বললেই নয়, প্র্যাকটিক্যাল বিষয়ে স্কুল বা কলেজগুলোতে গুরুত্ব দেয়া হয় না। ২৫ নম্বরের মধ্যে প্রায় সবাই ২০-এর উপরে নম্বর পায়। আমি কলেজে এসেও হতাশ হলাম। আমার মনে হচ্ছিল, শিক্ষাব্যবস্থায় কোথায়ও গলদ আছে। এরপর ল্যাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরো জোর দেই যেন পরবর্তী প্রজন্ম বিজ্ঞান শিক্ষাটা সহজে পায়। ফরিদুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময়ই বলছেন, আমাদের কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে, কারিগরি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। আমি এ কাজে সহযোগিতা করতে চাই। আর এ কারণেই আমি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে পদার্থ বিজ্ঞান শেখানোর চেষ্টা করছি। নবম-দশম শ্রেণির যে পদার্থ বিজ্ঞান এখান থেকেই মূলত কারিগরি শিক্ষার শুরু। শিক্ষার্থীরা এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ছে, তারা বাস্তবিক কিছু শিখতে পারছে না।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত