ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ!

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ!

বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছে চ্যাটজিপিটি। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বক্তব্য রয়েছে। চ্যাটজিপিটি নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। এরইমধ্যে নিষিদ্ধও হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই। প্রথম পশ্চিমা দেশ হিসেবে ইতালি চ্যাটজিপিটি নিষিদ্ধ করেছে। দেশটির তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রযুক্তিতে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় সেটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চ্যাটজিপিটি একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভিত্তিক সার্চ টুল। একটা চ্যাট বট। মাইক্রোসফটের সহযোগিতায় চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ ওপেনএআই। এই চ্যাটবট তৈরি করা হয়েছে জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার ৩ এর উপর ভিত্তি করে। এটি একটি অত্যাধুনিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এআই মডেল। আগের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে এটি অনেক উন্নত। চ্যাটবটের হালনাগাদ ভার্সন জিপিটি-৪ এখন বাজারে এসেছে। অর্থাৎ এই চ্যাটবট ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। আবার চ্যাটজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী গুগুলের বার্ড চ্যাটবট বাজারে এনেছে। এখানেই শঙ্কা রয়েছে। যখন একটি প্রতিষ্ঠান কোনো প্রযুক্তি বাজারে আনবে এবং বাজারে সাড়া ফেলবে ঠিক সেসময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান তার থেকে উন্নত কোনো মডেল আনার চেষ্টা করবে এবং আনবে। এই যে কম্পিটউটার, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন অ্যাপস, সফটওয়্যার ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রেই এমনটাই ঘটেছে। অর্থাৎ এসব উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যদি একই ঘটনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও ঘটে তাহলে তা শুধু ছাড়াতেই থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো যদি একসময় এর নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে না থাকে তখন কি ঘটবে? প্রতিযোগীতার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে থাকবে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হতে পারে? এই সম্ভাবনা কি একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায়? কারণ যেভাবে এর জনপ্রিয়তা, ব্যবহার এবং উত্থান ঘটছে তাতে ভবিষ্যতের কিছু শঙ্কা তো এসেই যায়। এই মডেল দ্বারা চ্যাটবট সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং যুক্তিযুক্তভাবে ফলাফল প্রদর্শন করে। যত সমালোচনাই আসুক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা থেমে নেই। এবং এর আধুনিক প্রযুক্তি এখন রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করছে। তবে সময়ে যতই এগিয়ে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা নিয়ে শঙ্কাও জাগছে। বিশেষজ্ঞরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত। সম্প্রতি জিওফ্রে হিন্টন টেক জায়ান্ট গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি তার কাজের জন্য অনুতপ্ত। এআই চ্যাটবটের বিপদ ‘বেশ ভয়াবহ’ বলেও সতর্ক করেছেন। এখন এই বেশ ভয়াবহ আসলে কতটা ভয়াবহ সে অবশ্য ভবিষ্যতই বলে দিতে পারে। তবে এটি যে মানুষের চিন্তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত। অনেকেই এখনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বন্ধ করার পক্ষে! আবার কেউ কেউ এটিকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন। এর কারণও রয়েছে। সম্প্রতি জানা গেছে, বিজ্ঞানী, ডাক্তার ও গবেষকদের বানানো নতুন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায় নির্ভুলভাবে ক্যানসার শনাক্ত করতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হবে একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। প্রশ্ন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে তখন তুলনামূলক কম বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে মানব জাতির ভবিষ্যত কি হবে? কারণ এখন পর্যন্ত এই মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষই স্বীকৃত। মানুষ কি নিজের চেয়ে বুদ্ধিমান কাউকে (যে হোক যন্ত্র) পৃথিবীতে রাজত্ব করতে দিবে? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রশ্নটি মানব জাতির অস্তিত্ত্বের।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট এখন সংবাদ পাঠ করছে, হাসপাতালে সেবা দিচ্ছে, চিকিৎসা করছে এবং লেখালেখিও করছে। অর্থাৎ মানুষ যা যা করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও সেটাই করছে। মানুষের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এমনকি চাকরির বাজার চলে যাচ্ছে রোবটের হাতে। আগে থেকেই মানুষের ধারণা ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হলে মানুষের চাকরির বাজার কমতে থাকবে। মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বের ৩০ কোটি পূর্ণকালীন কর্মী চাকরি হারাবেন। গুগুল এখন পরিকল্পনা করছে এআই দিয়ে কর্মীর চাহিদা পূরণ করার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মোট কাজের এক-চতুর্থাংশ কাজ করে ফেলতে পারে। এর আগে বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এআইয়ের মাধ্যমে ছবি আঁকার কারণে নিজেদের কর্মসংস্থানের ক্ষতি হতে পারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বেশ কয়েকজন শিল্পী। মানুষের দেয়া বুদ্ধিতেই মানুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এসব যন্ত্র। এখন চারদিকে যন্ত্রই সব। জোজি নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এক রোবট ১২০ ভাষায় কথা বলতে সক্ষম। জোজি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের নির্দেশনা বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী কাজও করতে পারে। একটি যন্ত্রকে বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিমত্তা প্রদান করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করতে চাইছেন। একসময় হয়তো দেখা যাবে মানুষ ও রোবট পাশাপাশি হাঁটছে কিন্তু কোনটা মানুষ আর কোনটা রোবট আমরা বুঝতে পারবো না। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ শুধু এটুকু বলেই থেমে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ঘটে। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের মতে, গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিস্কার হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের উন্নয়ন। তবে প্রতিযোগীতার বিষয়ে এখন অনেকেই তাদের অভিমত ব্যক্ত করছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রযুক্তি দুনিয়ার এক হাজারেরও বেশি মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, এআই সিস্টেমে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা সমাজ ও মানব জাতির ওপর গভীর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটি ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি এর জন ম্যাকার্থী সর্বপ্রথম এই শব্দটির উল্লেখ করেন। তাকেই অধিকাংশের মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর জনক হিসেবে অভিহিত করেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ক্ষেত্রগুলো হলো মেশিন লানিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, স্পিচ রিকগনিশন, রোবটিক্স, ভিশন, এক্সপার্ট সিস্টেম। অবশ্য এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে আরেকজন রয়েছেন। তিনি হলেন অ্যালান টুরিং। বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ এর গবেষণা ‘চার্চ-টুরিং থিসিস’ থেকেই এটি বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি ‘টুরিং পরীক্ষা’ নামের একটি বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। এই পরীক্ষাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি তৈরি করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার নিয়ে রচিত সায়েন্স ফিকশনগুলো বেশ জনপ্রিয়। মানুষ বহু আগেই তার লেখায় রোবটকে বুদ্ধি দিয়ে গল্প লিখেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দাবি করেছেন, আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষ তাদের সব কাজ বুদ্ধিমান মেশিনের সাহায্যে করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যাই বলি, এটা তো মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে একটি মেশিন যদি নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে এর ভালো এবং মন্দ দিকগুলো কি হবে? প্রযুক্তি আমাদের যেমন সুযোগ সুবিধা দিয়েছে ঠিক বিপরীতে আমাদের ক্ষতিও করেছে। প্রযুক্তি যেমন পৃথিবীর অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছে। সেভাবেই প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি। একই রকমভাবে কৃত্রিম বুদ্ধি সম্পন্ন কোনো যন্ত্র যে ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য বিপদজনক হবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায না। এর প্রধান কারণ মানুষ কোনো প্রযুক্তিই বিশ্বকে রক্ষার কাজে ব্যবহার করতে পারেনি। কেবল ধ্বংস ডেকে এনেছে। এআই এরই মধ্যে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ক্রমেই এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার এখন কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও চীন এগিয়ে গেছে এআই প্রযুক্তিতে। এছাড়াও মেটাও এআই প্রযুক্তি এনেছে। এ খাতে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাইছে প্রতিটি দেশই। এমনকি বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও কাজে লাগাচ্ছে এ সুযোগ। বিশেষত যখন এখানে প্রতিযোগীতা আসবে তখন আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেক্ষেত্রে কী ঘটবে তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত