সাহিত্যের সেরা ভূষণ বিদ্রোহী কবিতা
দেবব্রত নীল
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। স্থান-৩/৪ সি, তালতলা লেন, কলকাতা। গভীর রাতে হারিকেনের মৃদু আলোয় এক তরুণ কাগজে পেন্সিল ঠুকে-ঠুকে লিখে ফেললেন একটি কবিতা। লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ও সহানুভূতির চিরকুট তুলে ধরলেন ছন্দের আনন্দে। শাসকদের রোষাগ্নির বিরুদ্ধে কবি বজ্রবিদ্যুতের মতো দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন রক্তে দোলা জাগানিয়া সেই উচ্চারণ-
‘বল বীর.. চির উন্নত মম শির’
সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাস উলটপালট হয়ে গেল। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার দীপশিখা হয়ে আবির্ভূত হলো কবিতটি। ১৯২১ সালে রচিত বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ পূরণ হয় ২০২১ সালে। কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতায় সব অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, অসাম্যের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এ বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করেছেন পুরাণকে। তিনি অপরিসীম শক্তিমত্তা ও বলশীলতার পরিচয় দিতে গিয়ে কখনও রুদ্র, নটরাজ, ধুর্জটি, জমদগ্নি, অগ্নি, ইন্দ্রানী-সুত, কৃষ্ণ, ব্যোমকেশ, গঙ্গোত্রী, ঈশান, ধর্মরাজ, পিনাক, দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, বাসুকি, শ্যাম, বিষ্ণু,পরশুরাম, বলরাম, ভৃগু প্রভৃতি হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে সমীকৃত করেছেন, আবার কখনও ইস্রাফিল, বোরাক, জিব্রাইল, অর্ফিয়াস প্রভৃতি বিদেশি পৌরাণিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করে তুলে ধরেছেন নিজের বক্তব্য। অবতারণা করেছেন হিন্দু মিথলজি, গ্রিক ও ইসলামি ঐতিহ্য ছাড়াও ঐতিহাসিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব, প্রাকৃতিক ও মহাকাশ জগতের বিভিন্ন বিষয়ে। আরবি-ফারসি, ইংরেজি শব্দরাশির সঙ্গে ইসলামিক ও সেমিটিক ঐতিহ্য, দেব, দানব, মানব, প্রকৃতি, নিসর্গ, সমাজ, লৌকিক ভাবজগতের শব্দের মিলন ঘটিয়ে এক অভূতপূর্ব কাব্যধারা সৃষ্টি করেছেন।
১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ বিজলী পত্রিকায় ১৪৮ লাইনে প্রকাশিত হয় এ কবিতা।
কবিতায় আমি শব্দটি ১৪৩ বার ব্যবহার করা হয়েছে।
বিদ্রোহী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ৭ বার। নিম্নোক্ত পঙ্ক্তিসমূহে বিদ্রোহী শব্দটির উল্লেখ্য পাওয়া যায়।
১ : আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী- সূত্র বিশ্ব বিধাতৃর (২৩ নম্বর লাইন)।
২ : মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত (১৩০ নম্বর লাইন)।
৩ : বিদ্রোহী রণক্লান্ত (১৩৪ নম্বর লাইন)।
৪ : আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন (১৩৬ নম্বর লাইন)।
৫ : আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন (১৩৮ নম্বর লাইন)।
৬ : আমি চির বিদ্রোহী বীর (১৪০ নম্বর লাইন)।
বিদ্রোহী কবিতায় স্তবক সংখ্যা ১১টি। কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত মুক্তক ছন্দে লেখা। নজরুল বিদ্রোহী কবিতাটি ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগন্থে ও সঞ্চিতা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শব্দ বিশ্লেষণ, ছন্দের প্রয়োগ, গতি, ভাব, উদ্দীপনের অসাধারণ মেলবন্ধন তুলে ধরা হয়েছে কবিতার প্রতিটা বাক্যে, শব্দে আর অক্ষরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আমিত্বকে জাগিয়ে তুলে কবি বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবন সংগীতের সূচনা করেছেন। তার বিদ্রোহ শুধু পরাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, বরং সব অন্যায়-অত্যাচার, শাসক, শোষক ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে।
কাজী নজরুল ইসলামের অমোঘ সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতা বাংলা ভাষায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। বিদ্রোহী কবিতা আজন্ম নতুন, এ কবিতার আবেদন সর্বজনীন ও সর্বকালীন। শুধু শত বছর নয় সহস্র বছর পরেও বিদ্রোহী কবিতা চির অম্লান থাকবে। যতদিন মনুষ্যধামে অত্যাচারীর খ—গ কৃপানের কড়াঘাতে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ বাজবে ততদিন এ বিদ্রোহীর ফিনিক্স থেকেই জন্ম নিবে শত শত বিদ্রোহী। বিদ্রোহী মহাসিন্ধুর দ্বাররক্ষী হিসেবে চির উন্নত শিররূপে বিরাজমান থাকবে।