কবিতা লেখা হবে সমাজ ও পাঠকের মুক্তির জন্য। মানুষ যেন তার বেদনা, দুঃখ, ভালোবাসা এবং কষ্টের কথা কবির কবিতায় সহজে খুঁজে পায়। আমি বিশ্বাস করি কোনো দুর্বোধ্য কবিতা শ্রেষ্ঠ কবিতা বা প্রকৃত কবিতা হতে পারে না। যে কবিতা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। যেমন ভালোলাগার মানুষকে হৃদয় দেওয়ার পর প্রতারিত হলেও ভালোলাগা উবে যায় না। আর যে কবিতা পাঠকের ভালো লাগে- সে কবিতা কিন্তু আমরা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনগুলোতেও খুঁজে পাই না। তাই বিনয় মজুমদার তার ঈশ্বরীর স্বরচিত প্রবন্ধে বলেন- এ দেশে যেসব নির্বাচিত কবিতার সংকলন করা হয়, তার কোনোটাই পাঠকের ভালোলাগার বিষয় থাকে না। এমনকি সম্পাদক নিজে কবিতা নির্বাচন করার সময় পাঠকের মুখে-মুখে ছড়িয়ে যাওয়া কবিতাকে এড়িয়ে চলেন। অথচ এ কবিতাগুলোকে যদি সংকলনে রাখা হতো- তবে যেমন হ্রাস পেত অকবির সংখ্যা, ঠিক তেমনি হ্রাস পেত নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনের সংখ্যা।
কোনটি মহৎ কবিতা তা কাল বা সময় বলে না, বরং বলে পাঠক। কারণ সেই কবিতাগুলো মহৎ অথবা হৃদয় স্পর্শ করেছে বলে এই পাঠকই বিভিন্ন কালে সেই একই কবির কবিতা মনোযোগ সহকারে পড়ে। যেমনটা চিলির কবি পাবলো নেরুদা তার আত্মজীবনীতে বলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় এক বখাটের সঙ্গে তার বন্ধুদের ঝগড়া হয়। ঝগড়া থামাতে গিয়ে তিনি ওই বখাটেকে অতি উৎসাহী হয়ে উত্তমমধ্যম দেন। পরে তার বন্ধুরা তাকে জানায়- তুই যে ওকে মারলি তোর কপালেও মার অপেক্ষা করছে। এরপর থেকে নেরুদা তার ভয়ে বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটতেন না। একা তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাইরেও বের হতেন না। একদিন রাতে তিনি একা একা শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তার সামনেই সেই বখাটে পথ আটকে ধরল। নেরুদা ভাবলেন- এই বুঝি উত্তমমধ্যম দিল। ছেলেটি নেরুদাকে জোর করে টেনে নিয়ে একটি অন্ধকার চিপা গলিতে দাঁড় করাল। তারপর নেরুদাকে অবাক করে দিয়ে সে পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। নেরুদা তো পুরাই অবাক। যে প্রহার করার কথা, সে কি-না তার কাছে ক্ষমা চাইছে? অতঃপর বখাটে ছেলেটা জানাল যে, তার প্রেমিকা নাকি তাকে ধমক দিয়ে বলেছে- যে কবির কবিতা পড়ে আমরা প্রেম শিখলাম, তুমি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ। যাও তার কাছে মাফ চেয়ে আসার আগ পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা নেই।
সেজন্য ভালো কবিতা হলো তাই, যা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমি এমনটাই বিশ্বাস করি। তাই সহজবোধ্য কবিতা লেখার চেষ্টা করি। কারণ সহজবোধ্য কবিতাই আমাদের ভালোবাসতে শেখায়, বিদ্রোহী হতে শেখায়, আমাদের অগোচরে মনে গেঁথে যায়। যা মানুষের মুখে মুখে রটে যায় কখনো গান আকারে, কখনো প্রেমিকার চিঠির পদ্য হিসেবে, কখনো দুঃখ ক্ষোভ বা বেদনার অভিব্যক্তিরূপে, তাই শ্রেষ্ঠ কবিতা।
বসন্ত
অবহেলায় মন চাঁদের বাড়িতে আহত হয়ে
নীথর বসন্তকে দেখেতে যায় হলুদ জোছনায়।
হৃদয় ভর্তি ডায়াবেটিস চিকিৎসা করে
আহত মন সুখের খোঁজে দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে হৃদয়ের ফেরিওয়ালা শেয়ালের সখী
ঈগলের নখে যারা নিয়মিত ইতিহাস লিখি
তাদের প্রতিনিধি রচনা করে সোনার বাংলা।
আহা মা, মাটি জন্মভূমি-
তোমাকে বেদনায় কুঁকড়ে যেতে দেখে, কীভাবে?
কীভাবে বসন্তঘোষ কুহু কুহু অবিরত ডাকে?
আজকাল আবাস উজাড় হয়েছে বসন্তঘোষের
কেটেছি কুহু ডেকে বেদনা প্রকাশ করার ঠোঁট
তারপরও কোনো প্রতিবাদী বাতাস যদি আসে
আত্মা তার এলপিজি সিলিন্ডারে রাখি আটকে।
এরপর সিংহ থাকবে আসনহীন বকধর্ম হয়ে
সকল রাজা থাকবে প্রজার হাহাকার নিয়ে-
তারপর বীণ আর সাপের নাচে মাতবে সকাল
তারপর জীবনের খেলা ঘরে নামুক আকাল।
তারপর বাসন্তি রঙের শাড়ি জিন্সের চাপে পড়ে
তারপর লাজুক প্রেম টি-শার্টের আড়ালে পরে
সংস্কৃতি-সভ্যতা ছিঁড়ে যাওয়া ব্লাউজের মতো
কাঁটাতারে ব্যবচ্ছেদ হয়ে উদযাপন করবে বসন্ত।
সাধু না বিপ্লবী
যে তোমাকে আশাহত করেছে, তাকে ক্ষমা করো
অন্তত পাথর হয়ে তোমাকে সে পথ দেখিয়েছে
হাওরের শূন্যতা শ্রাবণে ভরাট হয় মিঠা আবেগে
যেখানে মাছের ডানায় ডুবুরি মন করে বিচরণ।
আমি সেই ডোবা মন খুঁজে ফিরি-
হতাশার মইয়ে আরোহণ করে লোভে
দুরন্ত শৈশব যেমন ভেসে যায় হাওরে
আমাকে ভেসে যেতে দেখো সেই মোহনায়
যেখানে বকের ঝাঁক প্রকৃতিকে পাহারা দেয়।
এখানে সূর্যের হাসি মানে বিরতিহীন শ্রম
ঝরে পড়া ঘামে নবজাতক ইতিহাসের জন্ম।
এখানে ভালোবাসা ঝুলে থাকে বাঁদুড়ের মতো
এখানে স্বপ্ন কেনা হয় প্রাণের বিনিময়ে।
ধ্যানমগ্ন সাধু যিনি হতাশা চিবাতে চায়
পরগাছা জীবন নিয়ে হেঁটে চলে যায় দ্বার থেকে দ্বারে
তাকে নিয়ে বুদ্ধির জীবিকা আর কত আয় করা যায়
দেশের জীবিকা ব্যাহত করে কারা সাধু সাজে বলো?
আমাদের প্রয়োজন একঝাঁক বিপ্লবী,
যারা ফযরের পর দরদের পারদ পড়ে
ভালোবাসা বুনে যায় আমাদের স্বপনে
আর আগামী তৈরি করে রক্তের সেচে।