ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গল্পে গল্পে রূপসী বাংলার পাখি

গাজী মুনছুর আজিজ
গল্পে গল্পে রূপসী বাংলার পাখি

ইনাম আল হক। পাখিবিশারদ, পাখিপ্রেমী বা পাখি অন্তপ্রাণ। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন পাখির পেছন। পাখি সম্পর্কে জানতে তার আগ্রহের শেষ নেই। পাখি দেখতে এ দেশের বন-বাদাড়, হাওরের জলা বিল, বা উপকূলের কাদা চরে তার ছুটে চলা নিরন্তর। কেবলই পাখির খোজে তার সকাল গড়িয়ে বেলা, বেলা গড়িয়ে বিকাল আর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। পাখিশুমারি, পাখির পায়ে রিং পরানো, পাখির পাখায় স্যাটেলাইট লাগানো- এমন নানা গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন সব সময়। অবশ্য পাখি সম্পর্কে তার এ জানার অভিযান কেবল নিজের জন্যই নয়। বরং তার জানাটুকু তিনি ছড়িয়ে দিতে চান দেশের মানুষের কাছেও। সেজন্য পাখি বিষয়ে নিয়মিত লেখেন। তবে তার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি অতি সহজ ভাষায় পাখির কথা লেখেন, যা ছোট-বড় সবার জন্যই হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য। বৈঠকী ঢঙে বা গল্পের ছলে তিনি পাখির কথা বলেন। ফলে অনাগ্রহী পাঠকও পাখি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অল্প সময়ের ভেতর। আর এ আগ্রহী পাঠকেদের জন্য তিনি এরই মধ্যে অনেকগুলো বই লিখেছেন। ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’; ‘পাখিদের সুখদুখের কথা’; ‘বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর মতো কত পাখি’; ‘সোনার পালক দিয়ে তিন কন্যার বিয়ে’- এমন সুন্দর সব শিরোনামে তার বইয়ের নামগুলো। এ ছাড়া সম্প্রতি বের হয়েছে ‘রূপসী বাংলার পাখি’ নামে তার নতুন বই।

এ বইয়ে ৮টি লেখা আছে। লেখাগুলোর শিরোনাম ৮টি পাখির নামে। আর পাখিগুলো আমাদের অতি পরিচিত। যেমন জাতীয় পাখি দোয়েল, পাপিয়া, ঈগল, ডাহুক, শালিক, প্যাঁচা, ঘুঘু ও মুনিয়া। তবে শিরোনাম ৮টি পাখির নামে হলেও লেখার ভেতরে আছে আরও অনেক পাখির কথা।

বইয়ের প্রতিটি লেখাই পাখিবিষয়ক আলাদা আলাদা গল্প, যে গল্পগুলো লেখকের ছোটবেলার। অর্থাৎ ছোটবেলায় লেখক যেসব পাখি দেখেছেন, কিংবা পাখিবিষয়ক তার ছোটবেলার গল্পগুলোই তিনি তুলে ধরেছেন পাঠকদের সামনে। বলা যায়, পাখিবিষয়ক স্মৃতিকথা। অবশ্য দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত লোকই তাদের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখে থাকেন। তবে আমার মনে হয়, পাখিবিষয়ক এমন আত্মজীবনী কেবল ইনাম আল হকই প্রথম লিখেছেন।

বইয়ের শুরুটা পাপিয়ার ভাষা শিরোনাম দিয়ে। হিজলেবট নামের যে গ্রামে লেখক ছোটবেলা কাটিয়েছেন, সেই গ্রামের কুঠিবাড়ি, তার খেলার সাথি কবির, বাবু, আনাম ও টুকুর কথা তিনি লিখেছেন। সেই সঙ্গে পাপিয়ার দেখা নিয়ে লিখেছেন চমৎকার স্মৃতিটুকু। পাপিয়ার সঙ্গে এ লেখায় আরও আছে গুইসাপ, কাঠবিড়ালী, বউকথাকউ, শালিক, বেনেবউ, লেখকের পরিবারের কথা, গ্রামের কথাসহ পাখিবিষয়ক মজার সব কথা। যেমন লেখক বলেছেন-

গাছে বউকথাকউ-পাপিয়া ডাকছে। বিরামহীন ডাক: ‘বোক্কো-টাকো, বোক্কো-টাকো, বোক্কো-টাকো, বোক্কো-টাকো অথবা বলছে: ‘বউক-থাকো, কউক-থাকো। জানিনে আসলে কী বলছে।

হেসে বাবু বলল: “পাখি কী বলছে জানিস”

আমি বললাম : “না, আমি তো পাপিয়ার ভাষা জানিনে।”

বাবু বলে : “আমি জানি। পাপিয়া বলছে, টুকু-টাক্কু, মোটা-মাথা, অঙ্কে-ডাব্বা, গদ্যে-ফেল।”

বাবুর মুখে অকর্ণ হাসি। পাখির সঙ্গে সুর মিলিয়ে সে ছড়া কাটল: “টুকু-টাক্কু, মোটা-মাথা, অঙ্কে-ডাব্বা, গদ্যে-ফেল, টুকু-টাক্কু, মোটা-মাথা.।”

বইয়ের দ্বিতীয় লেখার শিরোনাম দোয়েলের দেশে। এ লেখার শুরুতেই লেখক বলেছেন, আমার জীবনের প্রথম পাখি দোয়েল। না দেখেই তাকে আমি চিনেছি। আমার ঘরের পেছনে কলাবাগান। সেখানে এসে সে শিস দিত। সুরেলা কণ্ঠের শিস ‘চিইই-চিইই-চিহুইইচ’। চাচি বলেছিলেন : “দোয়েল ডাকছে”।

কেবল চাচির কথা নয়, দোয়েল প্রসঙ্গে এ লেখায় লেখক তার স্কুল জীবনের কথা, শিক্ষক, বড় ভাইয়ের কথা, শকুন, ময়ূর, শঙ্খচিল, ঘুঘু, টিয়া, কোকিল ইত্যাদি পাখির কথাও বলেছেন। সব কথাই এসেছে গল্পের ঢঙে। যেমন লেখক বলেছেন-

টিচার প্রশ্ন করলেন: “তোমার প্রিয় পাখি কী?”

আমি বললাম: “দোয়েল।”

টিচার বললেন : “এ জন্যেই দোয়েল হয়েছে দেশের প্রতীক।”

টিচারের কথায় আমি কাচুমাচু। আবার খুশিও হলাম। আমার প্রিয় বলে দোয়েল বাংলাদেশের প্রতীক হয়েছে।

আমি বললাম: “দোয়েল ছাড়া অন্য পাখি তো ভালোভাবে চিনিনে। চিনলে হয়তো ওরাও আমার প্রিয় হতো।”

এমন গল্পের ছলেই এগিয়েছে লেখাগুলো। আর লেখাগুলো পড়তে পড়তে পাঠকও ঢুকে যাবেন তার প্রিয় গ্রামে, যেখানে তিনি কাটিয়েছেন ছোটবেলার অনেকটা সময়।

বইয়ের তৃতীয় লেখার শিরোনাম ঈগলের দায়িত্ব। লেখক বলেছেন-

আমি একটা ঈগল চিনি। ঈগল পাখিটাও আমাকে চেনে। কাকাবাবুর দিঘি-লাগোয়া বরুণ গাছে সে বসে থাকে। কাকাবাবু আমাদের পড়শি। তার নাম যাদব পাল। আমি দিঘিতে গেলে পাখিটা উড়ে যায় না। দিঘির পানির দিকে তাকিয়ে সে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে ওর জোড়াটাও এসে বসে। কাকাবাবু বলেন: “ওরা হলো কুরাঈগল। ওরা থাকলে দিঘিতে মাছের রোগ ছড়ায় না। যে মাছের রোগ হয়, তাকে ওরা ধরে খায়। রোগ থেকে বাকি মাছ বেঁচে যায়। পয়মন্ত পাখি। ঈগল হলো কুরা, কাতল খেলে মুড়া।”

এ লেখায় গুটিঈগল, শিকরেঈগল, তিলা-নাগঈগল- এসবের কথাও আছে। আছে আরও অনেক মজার কাহিনি।

চতুর্থ লেখার শিরোনাম ডাহুকের আস্থা। লেখক বলেছেন-

ছুটির দিনে আমি নদীতে একা সাঁতার দিই। ডোবায় ডাহুক-ছানাদের বড় হতে দেখি একা একা। দাদার কবরের পাশে বসে থাকি। তার সঙ্গে কথা বলি। দাদার চেহারা আমার মনে নেই। দাদি বলেন, দাদা সারাক্ষণ কথা বলতেন। চাচা বলেন, দাদা সারাদিন হাসতেন আর মানুষকে হাসাতেন। কবরের পাশে আমি কান পেতে থাকি। দাদা কিছুই বলেন না। আমি দাদা হয়ে আমার সঙ্গে কথা কই।

শালিকের নালিশ, এটি বইয়ের পঞ্চম লেখার শিরোনাম। এ লেখার যে গল্প, তার এক জায়গায় লেখক বলেছেন-

কাকির বাড়িতে খেয়ে আরাম। কাকিমার বিশাল থালা থেকে খাবার পড়ে না। পুরো খাবার না-খেলে কাকিমা রাগ করেন না। বরং তার উল্টো। চেটেপুটে খেলেই তিনি থালায় আরও ভাত দেন। বলেন: “পুরোটা খেয়ো না। তাহলে পিপড়ে আর পাখিগুলো কী খাবে! হাত ধোয়ার সময় কুয়ো-তলায় খাবারগুলো ছিটিয়ে দিও।”

এই যে পাখির জন্য মানুষের অলিখিত দরদ, অন্যদিকে পুকুরের রোগা মাছ খেয়ে পাখি যে উপকার করছে আমাদের, এমন কথা বা সংস্কৃতিই উঠে এসেছে এ বইয়ে প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায়।

ষষ্ঠ লেখার শিরোনাম প্যাঁচার বকুনি। লেখক বলেছেন-

প্যাঁচা ভালোবাসেন আমার দাদি। দাদির ঘরে কাঠের সিলিং। সেখানে ছানাপোনা নিয়ে লক্ষ্মীপ্যাঁচা বাস করে। চাচি তাই দাদির ঘরে যায় না। সন্ধ্যায় দাদির ঘরে ‘হিস-হিস-হিস’ শব্দ হয়। লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক। দাদি ওদের সঙ্গে কথা বলেন। “এতক্ষণে তোদের ঘুম ভাঙল! যা এখন কুয়াশার মধ্যে।”

অন্ধকারে বেরিয়ে লক্ষ্মীপ্যাঁচা তখন কুয়াশা মাপে। ওদের আমি ভালো করে দেখতেও পাইনে। আজ দিনের আলোয় লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখার সুযোগ পেলাম। দাদির ঘরে মেরামত চলছে। মিস্ত্রি ঢুকল হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে। প্যাঁচারা উড়ে বাগানে এলো।

এ লেখায় প্যাঁচা নিয়ে প্রচলিত নানা সংস্কৃতি একটা ইঙ্গিতও লেখক দিয়েছেন। অবশ্য লেখক নিজে কিছু বলেননি। বরং তার চাচি কী বলল, দাদি কী বলল বা দাদা কী বলেছেন, কিংবা তারা যেটা বিশ্বাস করেন, সেসব কথাই তিনি সরল ভাষায় তুলে এনেছেন।

সপ্তম লেখার শিরোনাম ঘুঘুর ঘরবাড়ি। এ লেখাতেও এসেছে লেখকের টিচার, চাচি বা দাদির কথায় ঘুঘুর নানা প্রসঙ্গ। যেমন টিচার বলেন-

“পাখির জীবনে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। পাখির দশটি ছানার মধ্যে আটটিই মারা যায় বড় হওয়ার আগে। বড় হয়েও বিপদ যায় না। এক পাখি অন্য পাখিকে আক্রমণ করে। অসুস্থ, বয়স্ক ও দুর্বল হলেই পাখি নিহত হয়। আজকের দিনে মানুষের জীবন অত বিপদসংকুলন নয়।”

এ লেখায় প্যাঁচা, বনবিড়াল, রাজঘুঘু, মধুবাজ, শ্যামাঘুঘু, হরিয়ালের প্রসঙ্গও এসেছে।

বইয়ের শেষ লেখাটির শিরোনাম মুনিয়ার শাসন। লেখক বলছেন-

শুয়ে শুয়ে আমি একটা ছোট্ট পাখি দেখলাম। লাল টুকটুকে ঠোঁট। কাশের ডাটায় দোল খায় আর ডাকে: ‘পিট, পিট, পিট..।’ এ পাখি আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। কী এর নাম!

কমল কয়: “মামুনিয়া। এর নাম মামুনিয়া। এইটা মেয়ে পাখি; ছেলেডারে ডাকতাছে। নইড়ো না; ছেলেডা আইতে পারে।”

মামুনিয়া পাখি? কার মা? আমার মা? আমাকে দেখতে আসে না কেন! মা-মনি কি পাখি হতে জানে! মামুনিয়া পাখি কি বেহেশত থেকে আসে?

আরেকটা পাখি কাশের ডাটায় এসে বসল। এর সারা শরীর লাল। আমি বললাম: “অন্য আরেক জাতের পাখি এসেছে। আমি একে আগে কখনও দেখিনি।” কমল বলে: “অন্য জাতের পাখি না। এটাও মামুনিয়া। এইটা ছেলে।” আমি বললাম: “এটার নাম কি বাবা-মুনিয়া?” কমল বলে: “না, ছেলে মামুনিয়া। পাখির নাম মামুনিয়া। মেয়ে হলেও মামুনিয়া, ছেলে হলেও মামুনিয়া।”

এমন গল্পে গল্পেই লেখক বলে গেছেন পাখি নিয়ে তার স্মৃতিকথা। আর ঘুরেফিরে প্রায় প্রতিটি লেখাতেই এসেছে লেখকের টিচার, দাদা, দাদি চাচা, চাচি, কাকাবাবু বা কাকিমার কথা। তবে একটা বিষয়, লেখক প্রায় পুরো বইতেই ছোটবেলার স্মৃতিতে থাকা পাখির কথা বলেছেন; কিন্তু লেখক তার বাবা-মার কথা খুব কমই এনেছেন। বলা যায়, শুধু একটি লেখায় একটি জায়গায় একবার মায়ের কথা বলেছেন। কিন্তু লেখক যেহেতু ছোটবেলার কথা বলেছেন, তাই বাবা-মার কথাই বেশি থাকার আবদার ছিল।

আরেকটি বিষয় দেখেছি, লেখক তার চাচির কথা যতবার এনেছেন, ততবারই দেখেছি চাচি পাখির বিপরীতে বলেছেন। যেমন- চাচি বলেন: “প্যাঁচা কুলক্ষুণে। বাড়িতে প্যাঁচা, বাগানে প্যাঁচা; দিনরাত প্যাঁচা দ্যাখো। তাই তোমাগো আয়-উন্নতি নাই।”

চাচি আমাকে বলেন: “রাধা-ভাত খাও আর বাগানে ঘুরে বেড়াও। ভাবছো জীবন এমনেই যাবে? যাবে না। মানুষের জীবন কঠিন, পাখির মতো ফুরফুরে না।”

অন্যদিকে চাচি আর কাকিমার কথার মধ্যেও একটু ভিন্নতা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। যেমন লেখক বলেছেন-

আমাদের বাড়িতে এনামেলের থালা আর কাচের গ্লাস। এগুলো কাকিমার থালাবাসনের চেয়ে অনেক ছোট। আমি খেতে বসলে ছোট থালায় চারদিকে ভাত পড়ে যায়। চাচি রাগ করেন; বলেন: “হাশরের দিন এর হিসাব দিতে হবে।”

অন্যদিকে কাকিমার প্রসঙ্গে লেখক বলেন-

কাকির বাড়িতে খেয়ে আরাম। কাকিমার বিশাল থালা থেকে খাবার পড়ে না। পুরো খাবার না-খেলে কাকিমা রাগ করেন না। বরং তার উল্টো। চেটেপুটে খেলেই তিনি থালায় আরও ভাত দেন। বলেন: “পুরোটা খেয়ো না। তাহলে পিপড়ে আর পাখিগুলো কী খাবে! হাত ধোয়ার সময় কুয়ো-তলায় খাবারগুলো ছিটিয়ে দিও।”

আসলে, চাচি চেটেপুটে খেতে বলেছেন, কারণ খাবার অপচয় করা বা নষ্ট করা ঠিক নয়, এটা ভেবে। আর চাচি নিশ্চই পাখির জন্য আলাদা করে খাবার ছিটিয়ে দিতে মানা করেননি। অন্যদিকে কাকিমা পুরোটা না খেয়ে থালায় কিছুটা রেখে দিতে বলেছেন পিঁপড়ে আর পাখির জন্য। এটা প্রতি জীবের দরদের কথা।

সব মিলিয়ে পাঠক যখন বইটি পড়বেন, তখন তিনি হারিয়ে যাবেন নিজের শৈশবে, নিজের গ্রামে। সেই সঙ্গে পাখির জগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা যেমন পাবেন, তেমনি পাবেন পাখিবিষয়ক প্রচলিত কথাও।

৬৪ পৃষ্ঠার এ বইটি পুরোটাই রঙিন। প্রতিটি পৃষ্ঠায় আছে পাখির রঙিন ছবি। ইনাম আল হকের ছবি অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশ করেছে টুনটুনি। দাম ৩০০ টাকা।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত