উপস্থিত ভাই, বোন ও বন্ধুগণ। পঁয়ত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসবে যোগদানের জন্য আপনাদের প্রাণঢালা ভালোবাসা, অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই। আপনারা জানেন, ২০২০ সালে আমাদের ৩৪তম উৎসব নিবেদিত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে। অতঃপর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সুন্দর ও বর্ণাঢ্য উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা কবিতা উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মহামারির করাল গ্রাসের মুখে আমরা থমকে থাকতে বাধ্য হই। অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বনাশা ছোবলে খাদ্য ও জ¦ালানি সংকটের কারণে ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্বসমাজ আজ দিশেহারা। তবু, কিছুটা বিলম্ব হলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আবহে আয়োজিত জাতীয় কবিতা উৎসবের অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠ আজ ধারণ করেছে নতুন স্লোগান বা মর্মবাণী- বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, সর্বোপরি- উনিশশ’ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ বা বাংলার স্বাধীনতা। প্রাণের মূল্যে, রক্তের মূল্যে অর্জিত বাংলার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে আয়োজিত আজকের জাতীয় কবিতা উৎসবের মর্মবাণীর আলোকে সামান্য কিছু কথা আপনাদের উদ্দেশ্যে আমি নিবেদন করতে চাই।
শ্রদ্ধেয় সুধীমণ্ডলী। পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি কবি-লেখকদের ভূমিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-ত্রাসন থেকে মুক্তি পেতে আমাদের তৎকালীন বৃহত্তর ভারত ভূখণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের সঞ্জীবনী শক্তি তৎকালীন ভারতবাসীকে অকাতরে কারাবরণের পথ বেছে নিতে; কারাগারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহের গান গাইতে; এমনকি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিপুত্র-অগ্নিকন্যাদের আত্মদানে পর্যন্ত অনুপ্রাণিত করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতিবাদী কবিতা তাঁদের মুক্তির চেতনাকে শানিত করেছে। বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডা. সব্যসাচীর রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের নানান কৌশল; এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দেয়া মুক্তিকামী ভারতবাসীর বুকে অসম সাহস সঞ্চার করেছে। আরও আগে বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা: ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায়?/দাসত্বশৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়।...সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,/বাহু-বল তার।/আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,/দেশের উদ্ধার।’ -এই স্বপ্নের ধ্বনীরা কি মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনকে উৎসাহিত করেনি? এছাড়া তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমাতের কবিতা; চিলির মুক্তির সংগ্রামে পাবলো নেরুদার কবিতা; ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বিপ্লবে মাহমুদ দারবিশসহ অসংখ্য কবির আগুনঝরা কবিতার কথা মানুষ অনন্তকাল স্মরণে রাখবে। এভাবে মানব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দেশে দেশে মানবমুক্তির সংগ্রামে কবিদের প্রদীপ্ত উচ্চারণ সমাজ ও সভ্যতা বিকাশে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে।
একইভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ বলে দেশমাতৃকার বন্দনায় ও ভালোবাসায় বাঙালি জাতির জেগে ওঠা; কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট/ভেঙে ফেল্ র্ক রে লোপাট/... লাথি র্মা, ভাঙ্রে তালা!/যত সব বন্দী-শালায়- আগুন জ¦ালা,/আগুন জ¦ালা, ফেল্ উপাড়ি ॥’ -একাত্তরে কারাগার ভেঙে মুক্তিপাগল বাঙালির হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর...’ অথবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, ...’ -এসব কবিতা বাংলাদেশের অফুরান ধানের, স্নিগ্ধ নদীর জলের, হলুদ কাঁঠাল পাতার, বিচিত্র ঘাসের, ফুলের, পাখির; লাল ঘুঙুরপরা কিশোরীর হাঁসের, হরিণের-ফড়িঙের; সুনীল আকাশের আর হেমন্তের কুয়াশার গন্ধেভরা রূপসী বাংলার কোলে মাথা ঠেকাতে অধীর করে তোলে। কিংবা ‘...নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’ -১৯৭১ সালে বাংলার স্বাধীনতার আবাহনে শামসুর রাহমানের এমন কাব্যপঙ্ক্তি আমাদের প্রবলভাবে উদ্দীপিত ও আশান্বিত করেছে।
দেশপ্রেমিক ভাই ও বোনেরা আমার। আমি কবি। কবির শক্তিমত্তার প্রকাশ প্রকৃতি, প্রাণী ও মানবের মহিমা কীর্তনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধু মুজিবের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর মহিমা কীর্তনে আমরা গভীরভাবে লক্ষ করি- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু মুজিবের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। তাই, এই জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতিকে আমরা বলি- ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’। কারণ, আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশে^ রাজনীতির কবি অভিধায় অভিষিক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভাষণ-বক্তৃতা আর লেখালেখিও যেন মানুষের ভালোবাসায় অবিভূত এক মহৎ কবির শিল্পসুষমামণ্ডিত সৃষ্টিসম্ভার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন খণ্ডের মহাকাব্যোপম আত্মজীবনী : অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১৭), কারাগারের রোজনামচা (২০২০) এবং আমার দেখা নয়া চীন (২০২১) পাঠ করলে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে একজন স্বপ্নচারী শক্তিমান কবির সাবলীল কণ্ঠস্বর আমাদের হৃদয়-মনকে মথিত করে। গণমানুষের অফুরন্ত অনুপ্রেরণা ও মুক্তির উৎস তাঁর ভাষণের দোলায়িত ছন্দ ও কাব্যগুণ এতই শক্তিময় যে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তো বটেই, সারা দেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর বঙ্গবন্ধুর অমৃত ভাষণ কণ্ঠে ধারণ করে জনসমাজকে প্রতিদিনই উদ্দীপ্ত করে চলেছে।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের সব সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয় ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তারিখে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর লাখ লাখ জনতার মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- যা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কেউ কেউ আবার ৭ মার্চের ভাষণে সুদূরপ্রসারী আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান: ‘...আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’ উক্তিটিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য বাঙালি জাতির বুকে সাহস সঞ্চারী চিরকালীন কাব্যপঙ্ক্তি রূপে মান্য করেন। প্রসঙ্গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক সাময়িকী দি নিউজউইক-এর ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ অর্থাৎ রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। উল্লেখ্য, ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’- এই ধ্রুপদী পঙ্ক্তিটি তার প্রসাদগুণে আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে অগণিত মুজিব অনুসারীর কণ্ঠে অবিরত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্র্চলাইটের নামে নিরীহ-নিরাপরাধ বাঙালিদের হত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বাংলাদেশে সংঘটিত হয় বর্বরতম গণহত্যা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি বাহিনী। গ্রেপ্তারে আগে পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেও আরেক শ্রেষ্ঠ কবিতা:
ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। -শেখ মুজিবুর রহমান, ২৬ মার্চ, ১৯৭১
৭ মার্চের ভাষণে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তাঁর ডাকে ত্বরিত সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র-তরুণ-তরুণী, শ্রমিক-কৃষক-কৃষানি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়ায়। ৯ মাসের সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা- পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি সাড়ে সাত কোটি মানুষের ব্যাকুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানের অন্ধকার কারা-প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সগৌরবে ফিরে আসেন রক্তেভেজা মাতৃভূমির পবিত্র মাটিতে। বঙ্গবন্ধুর জেল-জুলুম-ত্যাগ-তিতিক্ষাসহ সব সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। সেই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া ও পরম পাওয়া। তাঁর জীবনের সাধনা ছিল ও দারিদ্র থেকে বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি আর দুঃখী মানুষের মলিন মুখে হাসি ফোটানো। তিনি যেমন এই শ্যামল বাংলা ও বাংলার মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন, তেমনি বাংলার সবুজ প্রকৃতি ও সরল মানুষ তাঁকে ভালোবেসে, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। তাই দেখি, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়- যখন তৎকালীন রেসকোর্সে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচনা করেন আরেকটি নতুন কবিতা। তার কিছু উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তি:
...আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। ...আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। ...আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম- তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই, শুধু আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও, এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।
আমি বলেছিলাম যাবার আগে- ও বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমি বলেছিলাম- ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করে সংগ্রাম করেছো। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি!
...জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে কবর খোঁদা হয়েছে। আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম; ...আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না এবং যাবার সময় বলে যাবো- জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।
কবি ও কবিতাপ্রেমিক বন্ধুগণ। আপনারা জানেন ও বিশ্বাস করেন- সব সুন্দরের শ্রেষ্ঠ সুন্দর হলো কবিতা। তাই, তুলনা করতে গিয়ে আমরা বলি- গল্প বা উপন্যাসটি যেন একটি সুন্দর কবিতা; রূপসী মেয়েটি যেন একটি নিটোল কবিতা; একটি সুন্দর বক্তৃতাকে তাৎক্ষণিক তুলনা করি অসাধারণ কবিতা বলে। ইতিহাসের প্রবল ঘটনা বা বিজয়ের কাহিনিকে তুলনা করি মহাকাব্য হিসেবে। শিল্প-সুষমায় সমৃদ্ধ এই কবিতা, কাব্য বা মহাকাব্যের স্রষ্টা হলেন কবি; এই কবি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বভৌম মানুষ। প্রাচীনকালে কাব্য রচনা ছিল জ্ঞানচর্চার সমার্থক। আমরা তো জানি, অতীতকালের প্রায় সব দার্শনিক, গণিতশাস্ত্রবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী- এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্রবিদদের মধ্যেও কাব্যচর্চার রেওয়াজ ছিল। তাঁদের কারও-কারোর লেখার বাহন ছিল কাব্যভাষা। যেমন, বিশ্বখ্যাত আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ-বিজ্ঞানী-কবি ইবনে সিনার রচনাসম্ভারের প্রায় অর্ধেকই ছন্দোবদ্ধ কবিতার ভাষায় লিখিত। ভাষার সুন্দরতম রূপ এই কবিতার সঙ্গে যেকোনো মহৎ সৃষ্টির তুলনা নতুন নয়। যেকোনো অনন্য সৃজনের স্রষ্টা মাত্রই একেকজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাই কবি উপাধিটি সমাজের কীর্তিমান মানুষদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের স্বীকৃতিজ্ঞাপক।
জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিতে- ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ তাঁর মতে- ‘...কবি তারাই যাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে; ...আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ জীবনানন্দের এমন ব্যাখ্যায়- কল্পনায়, চিন্তায়, অভিজ্ঞতায়, আধুনিক জগতের নতুন আলোয় উদ্ভাসিত এবং নানা রকম চরাচরের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কবি-পুরুষের ছবি আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান্তিমান অবয়বও আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সব কবির সৃষ্টির প্রধান পাথেয় স্বপ্ন, সাহস ও ভালোবাসা। আশৈশব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন, অসম সাহস ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই প্রধান পাথেয় ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের। তার শিল্পশৈলীসমৃদ্ধ রাজনীতির সোনালি ফসল এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এক অনুপম সৃষ্টি ও মহত্তম কবিতা।
তাই, বাংলার স্বাধীনতা আমার, আপনার ও অনাগত কালের সব বাঙালির এক প্রিয়তম কবিতা। আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে আয়োজিত আজকের জাতীয় কবিতা উৎসবে, বাঙালি জাতির মুক্তির আনন্দে সমবেত কবিকণ্ঠে গেয়ে উঠি- বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা।
আমাদের সবার কল্যাণ হোক। জয় বাংলা।
জয় বঙ্গবন্ধু।
মুহাম্মদ সামাদ, সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ।
(৩৫তম জাতীয় কবিতা উৎসব ২০২৩-এর উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানের ভাষণ)