আমি ও আমার কবিতা

আদ্যনাথ ঘোষ

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কবিতা হলো কবির অন্তর থেকে নিঃসারিত শৈল্পিক অনুভূতি। যার দার্শনিক মূল্য আছে, শিল্পমূল্য আছে। এর ভাষাশৈলী, ভাব, ছন্দ, অলংকার ও রস থাকা চাই। কবিতার এক অবশ্যম্ভাবী বাহন হলো নিমগ্নতা। প্রত্যেক কবির থাকে নিজস্ব কাব্যপ্রত্যয় এবং জীবন ও জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার স্বতন্ত্র অনুধ্যান। কবিতায় থাকে বাস্তবতা নিরীক্ষণ, কল্পনাশক্তি, দর্শন ও নৈতিকতা। পাঠক সমাজ তা পড়ে রসাস্বাদন করে এবং মনোজগতে আলাদা অনুভূতির অনুরণন সৃষ্টির প্রেরণা পায়। ছন্দবদ্ধ শব্দ হলেই কবিতা হয় না। কবিতা হয়ে ওঠার জন্য তাকে ভাব-তরঙ্গের বিশেষ ধ্বনিগুণ সমন্বিত অর্থনির্ভর ছন্দস্পন্দনে আবর্তিত হতে হয়। কবিতার মূল উপকরণ হলো রস, যা কবিতার আত্মারূপে প্রবাহিত হয়। কবিতা নিরাভরণা নয়। নারী যেমন আকার ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, বিলাসে, প্রসাধনে আপনাকে মনোরমা করে তোলে, কবিতাও তেমনি শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশ করে। কবিতার উদ্দেশ্য জগৎ ও জীবনের রহস্যকে সুন্দর ও রসস্নিগ্ধ করে উপস্থাপন করা। এ জন্য কবির কাছে সৌন্দর্যই পরম সত্যরূপে পরিগণিত যা কল্পনায় তিনি সত্য বলে প্রত্যক্ষ করেন। এই সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবিতার আরাধ্য। কবিতা আমাদের কাছে জীবনালোকের বার্তা আনয়ন করে। শ্রেষ্ঠ কবি জীবনের আদর্শ চিত্রাঙ্কনের সাহায্যে একদিকে যেমন পাঠকের মনে জীবন রহস্য উন্মোচিত করে তোলেন, তেমনি আবার কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে, এই গভীর প্রশ্নের উত্তরদানেও সহযোগিতার পথ খুলে দেন। উল্লেখ্য, স্বপ্ন ও কল্পনা একই বৃন্তে দুটি ফুল। আর কবিতা হচ্ছে ফল। এখানে কল্পনা আর স্বপ্ন একাকার হয়ে গড়ে তোলে কবিতার শরীর ও প্রাণ। একটি কবিতা রচনার জন্য কবি এমন স্বপ্ন দেখেন এবং এই ধরনের স্বপ্ন-কল্পনা তাকে কবিতা লিখতেও অনুপ্রাণিত করে। অন্যভাবে দেখলে, কল্পনা কবিতার একটি প্রধান উৎসভূমি। যিনি তার কল্পনার চোখ দিয়ে অতীতের সমুদ্রের অতল দেখে নিতে পারেন- যিনি চোখের সামনে উপস্থিত বর্তমানের স্থূল শরীর ভেদ করে রঞ্জনরশ্মির মতো সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে ঢুকে পড়তে পারেন কল্পনার দৃষ্টি মেলে- যিনি ভবিষ্যতের দূরবর্তী প্রাঙ্গণে কল্পনার দূরবিন যোগে পৌঁছে যেতে পারেন। তার পক্ষেই সম্ভব গভীরতর অনুভূতির কবিতা রচনা। আমার কাছে কবিতা নিরন্তর আরাধনা। যার মধ্যে মিশে আছে একাকিত্ব, ভাবনার বিশ্বস্ততা, আবেগ, গতিশীলতা, নিজের কাছে আসা, মানুষের কাছে যাওয়া, প্রকৃতির গোপনীয়তার প্রকাশ। আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি মানুষ তার ছায়ার সঙ্গে, আচরণের সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে আটকে আছে। কারণ, সমাজ ও সংসারের কাছে তিনি দায়বদ্ধ। কবিতা এই স্বপ্ন আর বাস্তবকে মেলানোর কাজটি করে থাকে। এক্ষেত্রে কবি এক নিরন্তর কারিগরের ভূমিকা পালন করে।

দু’চোখে আগুন জ্বেলে

বিস্তৃত দৃশ্যের সাথে- প্রজাপতি, শঙ্খচূড়, শিমুলের ফুল,

নীলের বাহার আর জোছনার আতর মেখে আমাকে কাছে ডেকেছিল।

বলেছিল- তুমিও কি আমাকেই সবুজ আঁধার ভেবে

অন্তঃপুরে ফেলে রাখ অনিবার্যভাবে- দু’চোখে আগুন জে¦লে-

ফাগুনের মাঠ, ভরা-নদী-ক্ষেত আর সপূর্ণ সিজদায় দহনের দীর্ঘশ্বাসে।

লালন হাওয়া

জলের সীমানা ঘিরে বিশুদ্ধ আকাশ।

নগ্ন স্লোগানের মোড় ভেঙে জাগে যে আগুন-

সে-এখন রাখালের সুরেতোলা বাঁশি,

মুগ্ধতার চিত্রালি মায়া; শুদ্ধতার সোনালি বুনট।

অশুদ্ধ সকাল কি ভেঙে ফেলে অনন্ত দুপুর?

নাকি অভিশাপের যন্ত্রণা মেপে যে শিকারি

এখন নৃত্যের পৃথিবী দোলায়-

যে- ক্ষুধার শুদ্ধস্বর শুধু

শরীরের কারুকাজ খোঁজে-

ধ্যান ও মগ্নের সিথান তলায়;

সে-এখন বৃত্তের পরিধি মাপে লালন হাওয়ায়।

 

অনন্ত অপেক্ষা এসে খেলা করে কাছে আর দূরে...

অনাহূত

অনাহূত,- ঘেয়েমি দুপুর নদী ডানা খুলে বসে আছে গভীর অসুখে।

কেনই বা বলতে যাব- ঘুমন্ত ঝর্ণারা রোদের পাখা নিয়ে

চিরটাকাল ঘুমিয়ে কাটায় অরণ্য ও বৃক্ষের বেপরোয়া চক্রের ভিতর।

সে কথা নাই বা বললাম। যেহেতু জন্মান্ধ পাখিদের কোনো ঠিকানা নেই।

দুপুরের নদীই যেখানে শুয়ে পড়ে, খোঁজার অজুহাতে তীব্রতা নিয়ে

থমকে দাঁড়ায় বাঁশবাগানের নিশাহীন চোখ,

অভিমানী ঝিলিক ঝিলিক রোদের উষ্ণতার চমকিত কথায়।

জানি শকুনের কোনো গন্তব্য নেই। নামহীন রঙের পাতিল নিয়ে দৌড় দেয়

আমারই কাফনের কাপড়। সেখানে আঁধারে আঁধার খেলে মিলন মেলায়, সভ্যতার রঙ্গমঞ্চ এসে খেলা করে উন্মাদিত গোলাপের কৈশোর প্রাণন।

বাঁশবনের আড়ালে নাচে সূর্যের লুকোচুরি খেলা।

কাছাকাছি নেই কোনো মানুষের ঘুম ভাঙার বিলাবলি গান।

বিলাবলের প্রহর এসে খুলে পড়ে সর্বনাশা প্রেমহীন অরণ্য ও বৃক্ষের কোলে,

আর থমকে দাঁড়ায় স্বপ্নবালিকার চুলের খোঁপায় অনাহূত সেই দুপুর নদী।