চে’র রূপকথা বিশ্ব সমান

কাজল রশীদ শাহীন

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পুরো পৃথিবীর কাছেই চে’ মানে মানুষের মুক্তি ও ন্যায্যতা প্রাপ্তির ও অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলন সংগ্রামে জপমন্ত্রবিশেষ। যদিও পুঁজিবাদী বিশ্ব তার রাজনৈতিক প্রকল্পে চে-কেও পরিণত করেছে পণ্যে। শুভবোধ ও শুভ ইচ্ছা বাস্তবায়নে নিবেদিত প্রাণ মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে জারি রেখেছে তার সব প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। তবুও তারা চে’কে আড়াল করতে পারিনি। মুছে দিতে পারিনি। চে’ যেভাবেই হোক হাজির রয়েছেন তরুণ প্রজন্মের মাঝে। হাজির রয়েছেন দেশে দেশে সব ভূগোলের ক্ষমতালিপ্সু ভূত ও ভৃগু ভগবানের বিরুদ্ধে। এখানেই চে’ নামের রূপকথার স্বার্থকতা। এখানেই চে’ চিরঞ্জীব ও সর্বজনে প্রণম্য-প্রেমময় এক নাম। চে-র রূপকথা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে, উনার জীবন ডায়েরির পাতায় পাতায়।

চে’র আসল নামটি বেশ বড়োসড়ো। এর্নেস্তো রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সের্না। আদর করে সবাই ডাকে চে নামে। যদিও পুরো নামের মধ্যে কোথাও নেই ‘চে’ শব্দের অস্তিত্ব। অথচ তিনি বিশ্বজুড়ে চে’ নামে পরিচিত। স্প্যানিশ শব্দ চে’র অর্থ প্রিয়। ল্যাতিন আমেরিকার দেশে দেশে-বিশেষ করে কিউবায় উনাকে ডাকা হতো চে বলে। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় প্রিয়জন। সেই থেকে মানুষের মুখে মুখে হয়ে ওঠেন তিনি চে, যার আড়ালে হারিয়ে যায় প্রকৃত নাম। একসময় তিনিও স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন চে। প্রকৃত নাম কিংবা তার কোনো অংশ নয় ‘চে’ হয়ে ওঠে বিশ্বখ্যাত বিপ্লবীর সিগনেচার নেম।

এভাবে একটা নাম, একজন ব্যক্তি, একজন মানুষের জীবনের যুদ্ধ ও স্বপ্ন হয়ে ওঠে রূপকথার গল্পসম। যদিও রূপকথার গল্পে থাকে আঞ্চলিকতার ছোপ ও ছাপ। যেমনটা আমরা পড়ে থাকি হররোজ। বাংলার রূপকথা সাক্ষ্য দেয় বাংলার। চীনা রূপকথা চীনের। রাশিয়ার রূপকথা রাশিয়ার। ইউক্রেনের রূপকথা ইউক্রেনের। যে কোনো দেশের রূপকথা তার ভাষার, জনপদের এবং এলাকার সাক্ষ্য দেয়। লাতিন আমেরিকার রূপকথা নির্দিষ্ট কোনো দেশের নয়, প্রতিনিধিত্ব করে পুরো লাতিন এলাকার। কিন্তু চে যে রূপকথার নায়ক-সেই রূপকথা নির্দিষ্ট কোনো ভূগোলের কিংবা দেশের-ভাষার-জনপদের-এলাকার নয়। সেই রূপকথা প্রতিনিধিত্ব করে পুরো বিশ্বের, সব ভাষার, সব দেশের, সব ভূগোল, সব জনপদ ও এলাকার। কারণ সেই রূপকথায় রয়েছে মানুষের-মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ইশতেহার। এ কারণে চে রূপকথা বিশ্বসমান।

চে জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায়। পড়েছিলেন চিকিৎসাবিদ্যা, পেশায় ছিলেন ডাক্তার। পছন্দ করতেন কবিতা- লিখতেন নিজেও। নেশা ছিল ভ্রমণের। অনুরাগ ছিল দাবা, ফুটবল ও রাগবি খেলার প্রতি। ১৯৬১ সালে হন কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সরকারের শিল্পমন্ত্রী। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া চে হলেন কিউবার রাষ্ট্রদূত হয়ে ঘোরেন বিভিন্ন দেশ। তারও আগে জড়িয়ে পড়েছিলেন গুয়েতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে-সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রতীতি থেকে।

এর পর ফিদেল কাস্ত্রোর সংস্পর্শে এসে জড়িয়ে যান কিউবার বিপ্লবী আন্দোলনে। সহযোদ্ধা হন ফিদেল-রাহুলের। দেশটির অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে দুই বছর ধরে সংগ্রামের পর পতন হয় সেই সরকারের। গঠিত হয় ফিদেল কাস্ত্রোর সরকার। কিন্তু সেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদেও থিতু হন না। ১৯৬৫ সালে সব ছেড়েছুড়ে কিউবা ছাড়েন তিনি। বিপ্লব সংগঠনের উদ্দেশে চলে যান লাতিন আমেরিকা থেকে আরেক মহাদেশ আফ্রিকায়। দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মুক্তি ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লব বিস্তারের স্বপ্ন দেখেন কঙ্গোয়। সেখান থেকে চলে যান বলিভিয়ায়। ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার সেনার হাতে বন্দি হন তিনি। সিআইএ-র মদদে সেনারা তাকে হত্যা করে ওই বছরের ৯ অক্টোবর।

চে সেই রূপকথার নায়ক, যে রূপকথা কল্পলোকের নয়, বাস্তবের। রূপকথায় রাজ্য ছিল, রানি ছিল, রাজকুমার ছিল, রাজকুমারী ছিল আর ছিল ক্ষমতা। কিন্তু এসবের সবকিছুই ছেড়েছিলেন তিনি। যার উদাহরণ পৃথিবীর জ্ঞাত ইতিহাসে রয়েছে শুধু একজনের। তিনি হলেন মহামতি বুদ্ধ ওরফে রাজকুমার সিদ্ধার্থ। যিনি মানুষের দুঃখ কষ্ট কীভাবে লাঘব করা যায়, মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ কীভাবে অন্বেষণ করা যায়, সেই লক্ষ্যে সব কিছু ছেড়েছুড়ে বেছে নিয়েছিলেন সন্ন্যাসের পথ, ধ্যান সাধনায় বসেছিলেন বোধবৃক্ষে।

মহামতি গৌতম বুদ্ধর আড়াই হাজার বছর পর বুদ্ধর মতো চে-ও সবকিছু ছেড়েছুড়ে বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। দু’জনেরই লক্ষ্য ছিল এক, উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন, চাওয়া ছিল মানুষের মুক্তি ও দুঃখ-দুর্দশা অপনোদন। বুদ্ধর সময়ের পথ ও পন্থা ছিল সন্ন্যাস গ্রহণ ও ধ্যানে নিমগ্ন হওয়া। চে’র সময়ের পথ হলো বিপ্লব। বুদ্ধ যদি জন্মাতেন চে’র সময়ে আর চে’ যদি হতেন বুদ্ধর সময়ের মানুষ, তাহলে উনারা হাঁটতেন ওই পথেই।

বুদ্ধ ছেড়ে এসেছিলেন প্রাণপ্রিয় সন্তান রাহুলকে। চে ছেড়ে এসেছিলেন আলেইদাকে। উনাদের কাছে মানুষের মুক্তি-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এতটাই প্রধান ও গুরুত্ববহ ছিল যে, তার জন্য প্রিয়তমার কোমলবাহু, আত্মজের জন্য এক পৃথিবীর মায়া এবং ক্ষমতার দম্ভ-লোভ লালসা এবং সবকিছু প্রাপ্তির সব নিশ্চয়তাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতে কোনো দ্বিধা কিংবা সংশয় কাজ করেনি।

প্রশ্ন হলো, যে চে-মানুষের মুক্তির জন্য এতকিছু করলেন, তার আদর্শ কতোটা ধারণ করা হচ্ছে। তার প্রত্যয় ও প্রতীতি থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে অন্ধকার দূর করার কতোটা আলো। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র তারুণ্যের টি-শার্টের বড়ো একটা অংশ জুড়ে রয়েছে চে’র ছবি সংবলিত ব্র্যান্ড। তরুণদের কাছে তো বটেই প্রায় সব বয়সী-যারাই ক্যাপ ব্যবহার করেন, তাদের পছন্দের তালিকা জুড়ে চে’র লোগো সংবলিত ক্যাপের প্রাধান্য বেশি। এমনকি মগ ও চায়ের কাপেও রয়েছে চে’র উপস্থিতি। যে চে’র ক্যাপ আমরা মাথায় ধারণ করি। চে’র ছবি সংবলিত গেঞ্জি আমরা পরিধান করি, সেখানে চে’র ছবিটা থাকে একেবারে বুকের কাছাকাছি, কোনোটা রয়েছে একেবারে বুক জুড়েই। বুকের সঙ্গে থাকার পরে এবং মাথার ওপরে রেখেও, এই চে-কে আমরা কতটা ধারণ করেছি সেই প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয় মোটেই। চে’ কী সত্যিই আমাদের বুক জুড়ে রয়েছে, নাকি করপোরেট দুনিয়ার আর দশটা পণ্যের মতো করেই আমরা চে’-কেও কেবলই পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছি?

চে কবিতা শুনতে পছন্দ করতেন, সে কথা আমরা আগেই বলেছি। শোনার পাশাপাশি কবিতা লিখতেনও। বিপ্লবী চে তাত্ত্বিক ছিলেন। কিন্তু তত্ত্বকথাতেই নিজের দায় ও দায়িত্বের ইতি টানেননি। তত্ত্বের সার্থকতা যে শুধু প্রয়োগেই, চে জীবন দিয়ে এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বামপন্থায় তিনি ছিলেন সমর্পিত প্রাণ। কিন্তু সেই বামপন্থাকেও বুঝে নিয়েছেন নিজের ও নিজেদের মতো করে নিজেদের ভূগোলের বাস্তবতায়। চে প্রকৃতার্থেই ছিলেন বিশ্ব নাগরিক। এ গ্রহের মানুষের মুক্তিই ছিল তার লক্ষ্য। এক জীবনের সাধনা ও ধ্যান-জ্ঞান। এ প্রেশ্নে তিনি আপস করেননি কখনোই। তিনি মনে করতেন বিশ্বমানবতার মুক্তি না ঘটলে কোনো এক বিশেষ দেশ বিশেষ অঞ্চলের মুক্তি টেকসই ও যথার্থ হতে পারে না।

এ কারণে মানুষের মুক্তির প্রশ্নে তিনি ক্ষমতা ছেড়েছেন তুড়ি মেরে। বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গুয়েতেমালা থেকে। তারপর কিউবা, কঙ্গো হয়ে বলিভিয়ায়। তিনি জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায় ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। স্বপ্ন ছিল ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের মুক্তি ঘটিয়ে বিপ্লবের লক্ষ্যে পাড়ি দেবেন আফ্রিকা, তারপর এশিয়া, ইউরোপ হয়ে তাবৎ বিশ্ব। তারপর প্রিয় পুত্রকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন চাঁদে। চে’র সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পূরণ হতে দেয়নি সিআইএ-বলিভিয়ার সামরিক সেনারা। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় চে-কে। যার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে হত্যা করা হয় বিশ্বের মানবমুক্তির এক মহান নায়ককে। যে নায়ককে স্মরণে আশ্রয় নিতে হয় জীবনানন্দ দাশের পঙ্ক্তির কাছে, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!’

চে’র মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘এক রূপকথার বিদায়’। এ শিরোনামের মধ্যে দিয়ে পত্রিকাটি পবিত্র এক সত্যই উচ্চারণ করেছিল সেদিন। চে’ সত্যিই বৈশ্বিক এক মিথ। সেই মিথ জন্মে দিয়েছে এমন এক রূপকথার, যে রূপকথা কোনো দেশ-অঞ্চল কিংবা মহাদেশের বৃত্তে আবদ্ধ থাকার নয়। চে সদর্থক অর্থেই বিশ্ব সমান এক রূপকথা। যে রূপকথার মোহনমন্ত্র ‘হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে’- বিজয় না পর্যন্ত লড়াই কর।