ভ্রমণ

কফি খেতে কফি হাউসে

গাজী মুনছুর আজিজ

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দুপুরের দিকে যখন কফি হাউসে আসি, তখন বেশ জমজমাট। নিচে কোনো টেবিলই খালি নেই। তাই আমরা আসি উপরের তলায়। এখানে এসেও কোনো টেবিল খালি পাইনি। অবশ্য একটু পরই বাম পাশের লবিতে দুটি চেয়ার খালি হয়। আমরা সেখানে গিয়ে বসি। আসলে কলকাতায় এলে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে এককাপ কফি খাইনি, বা একটু আড্ডা দিইনি, তা হয়নি। তাই কলকাতায় বেড়ানো আর কফি হাউসে কফি খাওয়া যেন একই সূত্রে গাঁথা। আর এবার আড্ডার সঙ্গী সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ।

আসাদ ভাই চেয়ারে বসেই মোবাইলে মান্না দে’র বিখ্যাত গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ বাজাতে লাগলেন। তার ভাষ্য, কফি হাউসে এসে যদি মান্না দে’র কফি হাউস গানই না শুনি, তাহলে আড্ডা নাকি জমে না। আমরা সাদা শেরওয়ানি ও মাথায় পাগড়ি দেওয়া একজন বেয়ারাকে ডেকে এগ স্যান্ডউইচ আর দুটো ঠান্ডা কফির অর্ডার দিই। কফি ৫৫ টাকা আর স্যান্ডউইচ ৫৮ টাকা। কিছুক্ষণ পর চলে এলো ঠান্ডা কফি আর এগ স্যান্ডউইচ। আমরা খেতে খেতে গল্প করি।

উপরতলা-নিচতলা সব টেবিলই কাণায় কাণায় পূর্ণ। নানা বয়সী মানুষ। সবাই গল্প-আড্ডায় মেতে আছেন। নতুন যারা আসছেন, তারা চেয়ার খালি না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, এরপর চেয়ার খালি হলে বসছেন।

এভাবেই সারাদিন কফি হাউস গল্প-আড্ডায় জমজমাট থাকছে।

এক সময় এ কফি হাউসই ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম আড্ডার জায়গা। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা সংগ্রামের সাক্ষী এ কফি হাউস। এখানে আড্ডা দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি। সেই সঙ্গে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথা ও সুপর্ণ কান্তি ঘোষের সুর করা মান্না দে’র কফি হাউস নিয়ে গানটি কফি হাউসকে করেছে আরও আবেগময়। সব মিলিয়ে এখানে কফি খাওয়া বা আড্ডা দেওয়া যেন ইতিহাসেরই সাক্ষী হওয়া। হয়তো এমনও হতে পারে, আমি বা আসাদ ভাই যে চেয়ারে বসে আছি, সেখানে হয়তো কোনো একদিন মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও কফি খেয়েছেন, আড্ডা দিয়েছেন। এসব ভেবে সত্যিই অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছে।

কলেজ স্ট্রিটের আশপাশে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সংস্কৃত কলেজ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ পাবলিশিংসহ স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থাগুলোও আছে এ কলেজ স্ট্রিট কেন্দ্রিক। বাংলা বইয়ের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজারও এ কলেজ স্ট্রিট। এমনকি এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজার হিসেবেও পরিচিত। আবার ২০০৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘বেস্ট অব এশিয়া’ হিসেবে কলেজ স্ট্রিট স্বীকৃতি পায়। এখানকার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চর্চাও এ কফি হাউস কেন্দ্রিক। তাই কফি হাউসে লেখক-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী, রাজনীতিক, শিক্ষার্থী সবাই আসেন কফি খেতে, আড্ডা দিতে। এ ছাড়া কলকাতায় বেড়াতে আসা পর্যটকরাও কফি হাউজে আসনে ইতিহাসের টানে, কফি খেতে-আড্ডা দিতে।

অবশ্য এক সময় এ কফি হাউসের নাম ছিল ‘অ্যালবার্ট হল’। মূলত কফি হাউস বাড়িটির মালিক ছিলেন ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের ঠাকুরদা রামকমল সেন। তিনি ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল এ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট’। এ ছাড়া রামকমল ছিলেন হিন্দু কলেজের ম্যানেজার। তার আগে তিনি তার বাসভবনের নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যালবার্ট হল’। রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামে এ নামকরণ। এ হলের ঔজ্জ্বল্য বেড়েছিল কেশবচন্দ্র সেনের সময়ে। ধীরে ধীরে এ ভবন হয়ে উঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও অন্যদের উদ্যোগে এ হলেই ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতসভা’ (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন)। এর পর ১৮৮৩ সালে এ হলে ‘ভারতসভা’র জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার এ হলে এয়ার রেড প্রিকশন সেন্টার খুলেছিল।

অন্যদিকে ১৯৪১ সালে মধ্য কলকাতায় আরেকটি ‘কফি হাউস’ শুরু করে ভারতীয় কফি বোর্ড। কবি সমর সেন, পরিচালক চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন নিয়মিত আড্ডা দিতেন সেই কফি হাউসে। সেই কফি হাউসে আমজনতা তেমন জেতেন না। আমজনতা আড্ডা দিতে আসতেন কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে। এর পর চল্লিশের দশকে কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ড হলেও ‘কফি হাউস’ শুরু করে ভারতীয় কফি বোর্ড। এর পর ভারত স্বাধীনের পর ‘অ্যালবার্ট হল’ পরিচয়ের আড়ালে (১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের) কফি হাউস হয়ে উঠে বাঙালির প্রধানতম কফিঘর হিসেবে। তখন এখানে আড্ডা দিতেন সাহিত্যিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, সমরেশ বসু, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, মণিশঙ্কর, বিমল মিত্র, ভবানী মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, তরুণ স্যান্যাল, অমিতাভ দাশগুপ্তরাও। আসতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং অপর্ণা সেনরা। আরও জড় হতেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাস, অসীম দাশগুপ্তের মতো বামপন্থি নেতারা।

এর মধ্যে ১৯১২ সালে অ্যালবার্ট হলের মালিকানা বদল হয়ে গিয়েছিল। আবার ১৯৯২ সালে কোর্টের রায়ে কফি হাউস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন অনেক ঘটনা, নানা টানাপড়েন ও আইনি জটিলতা পেরিয়ে ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কফি হাউসের নির্দিষ্ট অংশ কিনে নেয় রাজ্য সরকার। এর পর এটি তুলে দেওয়া হয় কফি হাউস সমবায়ের হাতে। বারবার অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে কফি হাউস। প্রতি বারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এখনও জেগে আছে ২৫০ বছরের বেশি প্রাচীন বাড়ির দোতলায় কফির কল্লোল। মান্না দে’র গানের মতোই ‘কত স্বপ্নের রোদ উঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়, কতজন এলো গেল কতজনই আসবে কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।’

তবে অ্যালবার্ট হল বা কফি হাউস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কলকাতায় কফি পানের প্রচলন শুরু করেছিলেন হেনরি পিডিংটন। তার উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যুবকদের মাদকের প্রতি আসক্তি কমানো।

আমরা ঠান্ডা কফি আর এগ স্যান্ডউইচ খেয়ে বেশ সময় গল্প করি। এরপর নিচতলায় এসে আবার বসি। এবার অর্ডার করি হট কফি। দাম ৩২ টাকা। কফিতে চুমুক দিতে দিতে আরও কিছু সময় আড্ডা দিই।