ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রবীন্দ্র সাহিত্যে বাঙালি মায়েরা

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
রবীন্দ্র সাহিত্যে বাঙালি মায়েরা

রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনে মাকে খুব একটা বেশি কাছে পাওয়া হয়নি। অকালপ্রয়াত বুধেন্দ্রনাথসহ মোট পনের সন্তানের মা সারদা দেবীর পক্ষে তার চতুর্দশতম সন্তানকে তত বেশি সময় দেওয়া হয়নি। ‘আমার ছেলেবেলা’ হতে জানা যায়, তিনি থাকতেন ওপর তলায় আর রবি থাকতেন নিচতলায় ভৃত্যসর্দার ব্রজেশ্বরের তত্ত্বাবধানে। রবি কী খাবে না খাবে, কিংবা কী তার বায়না, সে বিষয়ে সারদা দেবীর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি কেবল ওপরতলায় বসে ঘরের মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য তাস খেলতেন আর জমিদারগিন্নীদের যা হয়, অর্থাৎ আফিম সেবন করতেন। সে সময়ে এক-আধটুকু আফিম কর্তা মশায় বা কর্তামারা সবাই সেবন করতেন বৈকি। কেবল মাস্টার মশায়কে পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওপরতলায় মায়ের কাছে ধরনা দিতেন বালক রবি। মাও হাতে তাসের সজ্জা নিয়ে ব্রজেশ্বরকে বা মাস্টার মশায়কে বলে পাঠাতেন, আজ আর পড়াতে হবে না। এটুকুই ছিল রবির সঙ্গে মায়ের বলার মতো স্মৃতি। সারদা দেবী যখন মারা যান তখন ওপর তলা থেকে নিচতলায় রবিদের কানে খবরটি আসতে বেশ সময় লেগেছিল। নিস্তব্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মাকে দেখেও রবির তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি। ঘুমিয়ে থাকা মা যেন একটু পরেই উঠে যাবেন জেগে। কিন্তু মাকে যখন কপালে লাল সিঁদুর পরিয়ে শ্মশানযাত্রায় নেওয়া হলো তখন বুঝতে পেলেন রবি, মা বোধ হয় এবার আর ঘুম থেকে জাগবেন না। মা আর এবার যেখানে যাচ্ছেন সেখান থেকে ফিরে আসবেন না। মায়ের এ মৃত্যু নিয়েই রবি ভানুসিংহ নাম ধারণ করে মৃতুকে শ্যামের সঙ্গে তুলনা করেছেন কিনা তা জানা না গেলেও পরবর্তী সময়ে আপনজনদের মৃত্যু রবিকে একে একে কাছে থেকে দেখতে যেমন হয়েছে, তেমনি সইতেও হয়েছে।

শৈশবে মাকে অন্যসব ছেলেদের মতো কাছে না পেলেও মাকে নিয়ে অন্যদের মতো এক কল্পজগৎ রবির ছিল, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমরা ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় কল্পজগতে বিচরণকারী সেই কিশোরটাকেই দেখি, যে মাকে নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক ভ্রমণযাত্রায়। সব কিশোরের কাছেই জগৎ সম্পর্কে যেমন মা কম জানে তার চেয়ে, রবীন্দ্রনাথের কল্পজগতের কিশোরের মাও তেমনি। তিনি হেঁশেল আর সংসারের বাইরে একটি কদম পা রাখেননি কোথাও। এই বোকাসোকা আদরিণী মাকে নিয়ে খোকা যে ভ্রমণে বের হলো, সে ভ্রমণযাত্রায় মাকে দেখভাল করার দায়িত্ব যেন বীরপুরুষ খোকার। ডাকাতদের সঙ্গে লড়াইয়ে মা তাই ভয়ে ভয়ে পালকিতে এককোণে জড়সড় হয়ে কেঁপে কেঁপে ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করলেও তারই ছোট্ট খোকা হঠাৎ যেন বড় হয়ে যায়। তার বীরত্বে মা বেঁচে যাওয়ার যে কল্পকাহিনি বালক রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ে ধারণ করেছেন, তা তার বয়সি ছেলেদের এক কাঙ্ক্ষিত কল্পলোকের ফিকশন।

আরও যখন বড় হলো রবি তখন হয়তো কখনো সখনো মা এসে স্মৃতিতে হানা দিয়ে যেত। কিন্তু অভিমান ভরে তা স্বীকার করার দায় দেখায়নি মাতৃহারা বালক। ‘শিশু ভোলানাথ’ এর ‘মনে পড়া’ কবিতাটি আমাদের কবির সেই অভিমানকেই মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে রবি কবি যখন চোখ ছলছল অবয়বে বলে, ‘মাকে আমার পড়ে না মনে। শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে একটা কী সুর গুনগুনিয়ে

কানে আমার বাজে, মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।’

খেলতে খেলতে আপনমনে রবি উপলব্ধি করে, মা চলে গেছে চিরতরে, কিন্তু তার জন্য রেখে গেছে গুনগুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর গান। সেই গানের সুর আজও খোকা রবির কানে বাজে খেলার প্রতিটি মুহূর্তে।

রবীন্দ্রনাথের মায়েদের মধ্যে সত্যিকারের এক মায়ের চরিত্র ‘আনন্দময়ী’। আনন্দময়ী পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় ছুঁৎমার্গ বিষয়ে শতভাগ গোঁড়া। কিন্তু সেই মায়ের কোলে যখন গোরা মানে গৌরমোহনের আগমন ঘটল, তখন মাতৃত্বের মমতায় তার সেই ধর্মীয় সংস্কারের সবটুকু আগল ভেঙে গেল। আমরা পেলাম তখন শাশ্বত এক বিশ্বজননীকে, যিনি কোলে ও অন্তরের মাঝে ধারণ করতে পারেন জগতের সব সন্তানকে। আইরিশ দম্পতির জীনজাত সন্তান গোরা যাকে দাঙ্গার সময় পাওয়া গিয়েছিল রাস্তায় বিপজ্জনকভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায়। সেই গোরাকে যখন আনন্দময়ী পেলেন, তখন আর তার ছুঁৎমার্গ রইল না। অন্তরের সর্বস্ব দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন গোরার মা। গোরার বন্ধু বিনয় ব্রাহ্মদের সঙ্গে সংযোগ রাখার কারণে গোরা তাকে পরিত্যাগ করতে চায়। মা আনন্দময়ী এসে গোরাকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে চাইলেও গোরা অনড়। তবু খাঁটি ব্রাহ্মণরূপে নিজেকে গড়ে তোলা গোরাকে মা আনন্দময়ী কখনো একবারের জন্যেও বুঝতে দেননি, আইরিশজাতক গোরার নিজের গোড়াই টলোমলে।

চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যে চণ্ডালকন্যা প্রকৃতির মা মায়া, যিনি মেয়ের আহত মনকে প্রশমিত করতে জাদুমায়ার আশ্রয় নেন। জাতপাতের আগল টেনে সমাজ চণ্ডালকন্যা প্রকৃতিকে নির্মমভাবে আহত করে। সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে মা মায়াবলে বুদ্ধসেবক আনন্দকে ঘরের মধ্যে এনে আটকে রাখেন। এখানে প্রকৃতির মা হিসেবে মায়া তার অপত্যস্নেহে বেদনার্থ মেয়ের জন্য অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হতে দ্বিধান্বিত হননি। মেয়ের প্রতি ভালোবাসায় তিনি পাপ হবে জেনেও আনন্দকে আটকে রেখে বলেন, ‘বাছা, তুই যে আমার বুকচেরা ধন।

তোর কথাতেই চলেছি পাপের পথে পাপীয়সী

হে পবিত্র মহাপুরুষ, আমার অপরাধের শক্তি যত

ক্ষমার শক্তি তোমার আরো অনেকগুণে বড়

তোমারে করিব অসম্মান

তবু প্রণাম তবু প্রণাম তবু প্রণাম।’

‘মালিনী’ কাব্যনাটকে রাজকন্যা মালিনীকে স্নেহের ফলগুধারায় সিক্ত করে রাজমহিষী মা বিচলিত হয়ে ওঠেন। তার বৈরাগ্য সাধনের সংকল্পে মা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের সম্মুখীন হন। তিনি মেয়েকে সজ্ঞানে ফিরিয়ে আনতে বলেন, মা গো মা, কী করি তোরে লয়ে। ওরে বাছা,

এ-সব কি সাজে তোরে কভু, এই কাঁচা নবীন বয়সে?

কোথা গেল বেশভূষা কোথা আভরণ?

আমার সোনার উষা স্বর্ণপ্রভাহীনা, এও কি চোখের ‘পরে সহ্য হয় মা’র?

যুক্তিতর্কে মালিনী তার মাকে পরাস্ত করে ফেলে। মা মুগ্ধ হয়ে রয়। মুখে কোন কথাই যেন যোগায় না। সন্তান বাৎসল্যে মুগ্ধ মা বলে ওঠে,

কে তোমারে বোঝে মা আমার! কথা শুনে জানি না কেন যে

চক্ষে আসে জল। যেদিন আসিলি কোলে বাক্যহীন মূঢ় শিশু, ক্রন্দনকল্লোলে মায়েরে ব্যাকুল করি, কে জানিত তবে সেই ক্ষুদ্র মুগ্ধ মুখ এত কথা কবে দুই দিন পরে। থাকি তোর মুখ চেয়ে, ভয়ে কাঁপে বুক। ও মোর সোনার মেয়ে...’

‘শেষের কবিতা’র যোগমায়া এক মায়াবতী মমতাময়ী মা। বাস্তবে তিনি অমিত রায় বা লাবণ্য-কারুরই মা নন। কিন্তু তার মাঝে মাতৃত্বের ফলগুধারা বয়ে চলেছিল অন্তরজুড়ে। পাহাড়ি পথের পাগলামো দুই পথিক তথা অমিত-লাবণ্যকে কাছে এনে দিলেও, তাদের জোড় বাঁধার অনিশ্চিত সময়ে তিনিই হয়ে ওঠেন লাবণ্যর মা। নিজের মেয়ের প্রতি যে টান মায়েদের থাকে, লাবণ্যর প্রতি যোগমায়ারও সেই টান এবং সেই দায়িত্ববোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অমিত রায় প্রথম দর্শনে যোগমায়াকে বর্ণনা করছেন এভাবেই, চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স, কিন্তু বয়সে তাকে শিথিল করেনি, কেবল তাকে গম্ভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গৌরবর্ণময় মুখ টস টস করছে শুভ্রতায়। বৈধব্যরীতিতে চুল ছাঁটা; মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চোখ; হাসিটি স্নিগ্ধ। মোটা থান চাদরে মাথা বেষ্টন করে সমস্ত দেহ সমবৃত। পায়ে জুতো নেই, দুটি পা নির্মল সুন্দর। মাসীজ্ঞানে অমিত তার পায়ে হাত দিয়ে যখন প্রণাম করল, তখন ওর শিরায় শিরায় যেন দেবীর প্রসাদের ধারা বয়ে গেল। আর যোগমায়াও লাবণ্যের দিকে আড়চোখে চেয়ে একটু হেসে মনে মনে ঠিক করে নিলেন, এদের দু’জনের জোড় খুব মানাবে।

নিজের বিভিন্ন রচনায় মায়ের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভুলে যাননি কিন্তু মা-হীনতার দুর্দশার কথা। রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় মা-হারাদের কথাও আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। মাতৃহীন হৈমন্তী ঋষিতুল্য বাবার কাছে বড় হলেও, মায়ের শিক্ষা ও মমতা না পাওয়ায় তার বয়স সমাজের ষোল হয়ে গেছে বটে তবে সে তার স্বভাবে পরিণত হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ সে ষোল স্বভাবের ষোল হয়ে ওঠেনি। আবার মাতৃপিতৃহীন অনাথ রতনকেও তিনি চিত্রিত করেছেন মা-হীনতার দুর্দশা দেখিয়ে।

অন্য মায়েদের চেয়ে বাঙালি মায়েরা একটু বেশি স্নেহময়ী। রবীন্দ্রনাথের রচনায় বর্ণিত মায়েরাও তাই। রবীন্দ্র-রচনায় মায়েরা গরিব হলেও আদর্শবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও মমতাময়ী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত