গল্প

বধিরের দেশে ঢোলের কারিগর

সৈয়দ আনোয়ার রেজা

প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গোটা গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল। কোনো গেরস্থের ঘরে একটি গরুও বাঁধা নেই। সব মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ছাগলও অবমুক্ত। ঘরের পাহারাদার শিকারি কুকুরটিও অবাধে ঘুরছে এদিক-ওদিক। যেকোনো সময় মানুষের পায়ে বসিয়ে দিতে পারে তার বিষাক্ত দাঁত। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে আর অবাধ দৌড়াদৌড়িতে গ্রামের সব রাস্তা সুন্দরবনের ঝোপ-ঝাড়ের রাস্তার মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে ময়না আর তার বান্ধবীদের কথা শুনেই গ্রামবাসীর এ সিদ্ধান্ত।

গ্রামের কারো ধানক্ষেত, ফসলের ক্ষেত আর অক্ষত নেই। গরু-ছাগল সবাই মিলে গ্রামের সব ক্ষেত সাবাড় করে দিয়েছে। এবার তারা হানা দিয়েছে বাড়ির উঠানে, বাড়ির আশপাশের সব ক্ষেতে। ফুলগাছ, ফলগাছ কিছুই বাকি রাখছে না। কেউ বাধাও দিচ্ছে না। গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়িও রক্ষা পায়নি। চেয়ারম্যান গ্রামের সবাইকে আদেশ দিলেন।

‘গরু-ছাগল, কুকুর যার যার ঘরে বেঁধে রাখতে হবে’। কেউ চেয়ারম্যানের কথা শুনল না। গরু-ছাগল, কুকুর আগের মতোই খোলা ঘুরছে। গ্রামে খাদ্যের অভাব দেখা দিল। বাজারে শাকসবজি নেই। নতুন ধান ওঠেনি। সব গেছে গরুর পেটে। গ্রামের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে সদ্য স্বামীহারা বিধবার মনের মতো। গ্রামের মানুষ না খেয়ে থাকবে তবুও গরু-ছাগল, কুকুর ঘরে আনবে না। এর মধ্যে অনেকেই কুকুরের বিষদাঁতের স্বাদ হজম করেছে। অনেকেই বিশেষ করে ছোটরা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও কেউ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হচ্ছে না।

গ্রামবাসী দ্বিতীয়বারের মতো উঠানসভার ডাক দিয়েছে। গ্রামের পুরুষ-মহিলা, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই উপস্থিত হয়েছে। ময়নার বান্ধবীরা উঠানে গোল করে বসে আছে। ময়না সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলছে, শক্ত হতে বলছে। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সন্ধ্যার নিভু নিভু কুপির আলোতে তার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে ইটভাঙার হাতুড়ির মতো তার কণ্ঠ শুনতে কারো কষ্ট হচ্ছে না। সে বলছে; চাচারা, মামারা আমার, আপনারা যখন জমিতে চাষ করেন তখন যদি দেখেন জমির একটা আইল ভেঙে গেছে তখন কী করেন? ওই ভাঙার চারদিকে আরও কিছু অংশ কাটেন না? কাটার পর ওটা মেরামত করেন না? আবার যদি দেখেন পানি সেঁচের কোনো রাস্তা ভেঙে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে তখন কী করেন? প্রথমে ওই রাস্তা পুরোটা বন্ধ করে তারপর ঠিকমতো রাস্তা করে দেন না?

সবাই বলল; হ্যাঁ, সেটা তো করি, কিন্তু ওইটার সঙ্গে গরু-ছাগল, কুকুর ছেড়ে দেওয়ার সম্পর্ক কী? ময়না বলল; সম্পর্ক আছে, সম্পর্ক আছে। এখন আমাদের গ্রামকে মনে করেন একটা ধানের জমি। এ জমির আইল ভেঙে গেছে, পানি সেঁচের রাস্তা ভেঙে গেছে। তাই আমরা সেটা মেরামত করছি। আইলের চারদিকে কেটে পরিষ্কার করছি। সেঁচের রাস্তা আপাতত বন্ধ রেখেছি সেটা মেরামত করার জন্য।

একজন মুরব্বি উঠে বললেন; মা, আর কিছুদিন এভাবে চললে আমাদেরকে না খেয়ে থাকতে হবে। ময়না বলল; মামা, আপনি আপনার মেয়েকে ভালোবাসেন? আপনার মাকে ভালোবাসেন? আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন?

এসব কী বলছ মা? কেন ভালোবাসব না?

তাহলে তাদের জন্য একটু কষ্ট করেন মামা। আমি জানি কাল-পরশুর মধ্যেই চেয়ারম্যান সাহেব...

ময়না কথা শেষ করার আগেই চেয়ারম্যান সাহেব উঠানে এসে হাজির। পেছনে আরও কয়েকজন লোক। ‘কালও না, পরশুও না, আমি আজ রাতেই একটা সুরাহা করতে চাই। আমার কথা শুনে না এমন মানুষ এ গ্রামে আছে, আমার জানা ছিল না।’ হুঙ্কার ছাড়লেন চেয়ারম্যান সাহেব।

সবাই উঠে দাঁড়াল। থরথর করে কাঁপছে চলন্ত গাড়ির জানালার কাঁচের গ্লাসের মতো। চেয়ারম্যান সাহেব হুঙ্কার ছেড়েই যাচ্ছেন; ‘তোমরা নাকি আইন করেছ, গ্রামে কেউ চাষ করতে পারবে না। কেন? ঘরের কুকুর কেন রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছ তোমরা? মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না, জানো না তোমরা?’

ময়না বলল; চাষ করলে গরু-ছাগল ওসব খেয়ে ফেলবে, তাই চাষ বন্ধ। আর মানুষ যদি ঘর থেকে বের না হয় তাহলে কুকুর কামড়াবে কীভাবে?

‘তো, তোমরা গরু-ছাগল বেঁধে রাখতে পারো না? কুকুর রাস্তায় ঘুরবে আর মানুষ ঘরে বন্দি থাকবে? এ কেমন আবদার তোমাদের? মগের মল্লুক পেয়েছ তোমরা?’ চেয়ারম্যান সাহেব আবার হুঙ্কার দিলেন।

এবার ময়নাও হুঙ্কার দিয়ে উঠল; আমাদেরও একই প্রশ্ন। এটা কি মগের মল্লুক?

‘কী বলতে চাও তোমরা?’ চেয়ারম্যান সাহেবের রাগ আরও বেড়ে গেল।

ময়না বলে, আমি সেদিন স্কুলে যাচ্ছিলাম আমার বান্ধবীরাসহ। আপনার ছেলে এসে কী করল? আমাদের গায়ে হাত দিল। কয়েকজনকে চুমু দিল। আমরা গেলাম আপনার কাছে বিচার চাইতে। আপনি কী বললেন? বললেন; ‘আমার ছেলে যতদিন গ্রামে থাকবে ততদিন কোনো মেয়ে যেন ঘর থেকে বের না হয়, স্কুলে না যায়, বাজারে না যায়। আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ মেয়ে দেখলে আমার ছেলে ঠিক থাকতে পারে না! তার মানসিক সমস্যা আছে। কিছুদিন পর সে আবার শহরে চলে যাবে, তখন সবকিছু আগের মতো চলবে, মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে।’

এখন আপনি বলেন, আমরা গরু বাঁধব, নাকি গ্রামের কেউ ক্ষেত করতে পারবে না, এ আইন থাকবে? কুকুর রাস্তায় ঘুরবে আর মানুষ ঘরে বন্দি থাকবে, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে? নাকি কুকুর এনে ঘরে বাঁধব আর মানুষ বাইরে যাবে? আর আপনি কী করবেন, আপনার ছেলেকে শাসন করবেন নাকি গ্রামের মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখবেন?

পুরো উঠানজুড়ে বসন্তের বাতাস বইছে। উঠানের পাশের গাছের পাতাগুলো শনশন শব্দ করছে। আকাশের চাঁদটা আস্তে আস্তে আলো বাড়াচ্ছে। চাঁদ থেকে একখণ্ড জোছনা এসে উঠানে খিলখিলিয়ে হাসছে...