ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আপসহীন নজরুল

কাজল রশীদ শাহীন
জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আপসহীন নজরুল

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ‘ধূমকেতু’র মতো। কিন্তু আসন গেঁড়ে হয়ে উঠেছেন ‘কালপুরুষ’ এর মতো চিরস্থায়ী। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো উদিত হয়ে অস্তপারে পাড়ি জমাননি। দেশ ও জাতির সংকটে সুবিধাবাদ ও উপঢৌকন বিলাসে আখের গোছাননি। বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালনে নজরুলের ভূমিকা তাই বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়াতেও তুলনারহিত। বাঙালি কবি নজরুলের মতো আর কাউকেই জেল জুলুম, নিষেধাজ্ঞা, বই বাজেয়াপ্তকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি।

দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯২৩ সালের মার্চে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নামের মতো ‘ধূমকেতু’র ভাগ্যও ছিল একই সুতোয় গাঁথা। বিজ্ঞানের তরফে আমরা জানি, হ্যালির ধূমকেতুর কথা। পৌনে এক শতাব্দীতে কিংবা তার কিছুটা আগে-পরে যা আবির্ভূত হয়। জানান দেয় মহাজাগতিকতার বিপুল বিস্ময়। হ্যালির ধূমকেতুর যেমন মহাজাগতিকতার বিপুল বিস্ময়, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তেমনি যে কোনো দেশ ও জাতির ‘জাতীয়তাবাদে’র প্রশ্নে অন্তহীন এক বিস্ময়ের নাম। যেখানে তালাশ করলে কেবলই মনি-মানিক্য আর হীরে-জহরত মেলে। যে কোনো ভাষাভাষি মানুষের ভূগোল ও ভগবানের কেবলা নির্ধারণে এ কবিতা চাবিকাঠি বিশেষ।

কবিতা ‘বিদ্রোহী’ কেবল কাজী নজরুল ইসলামের ‘সিগনেচার পোয়েম’ নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও ‘সিগনেচার পোয়েম।’ যখন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হচ্ছে সেই সময়কালের দিকে যদি আমরা গভীরভাবে দৃষ্টি দিই, এ সত্য ঠাহর করা যায় নিশ্চিতভাবেই। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার আগের ও পরের বাংলা ও ভারতবর্ষ-ই বলে দেয় এ কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তি পালন করেছে কতটা প্রবল ও প্রভাববিস্তারি ভূমিকা। কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’র পর যা কিছু সৃজনশীল ও মননধর্মী লেখা লিখেছেন তার সবটাই ‘বিদ্র্রোহী’ কবিতারই বিবিধমাত্রার সর্বৈবপ্রকাশ ও সম্প্রসারণ। এমনকি নজরুলের সাংবাদিক সত্তায় দেশপ্রেমের প্রশ্নে যে প্রত্যয় ও অগ্নিমন্ত্রের শপথ প্রজ্বলিত হয়েছে তার সবটাই ‘বিদ্রোহী’ থেকে আহরিত। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার বিষয় ও বিষয়ী সেসেবর উজ্জ্বল সাক্ষ্য।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে তো বটেই, ভারতবর্ষেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়ে বিপুল সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত একজন কবি। বিদ্রোহীর আগে যার পরিচয় ছিল সৈনিক বা হাবিলদার কবি হিসেবে। বিদ্রোহীর মধ্য দিয়ে আবিভূত হলেন বিদ্রোহী হিসেবে। কবিতায় তিনি যা বলতে চেয়েছেন- যা বলেছেন, তাতে উক্ত হয়েছে একজন কবির দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রত্যয়। দীর্ঘ কবিতায় তিনি যা বলেছেন, তা শুধু বিস্ময়ের নয়, দেশ ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বিশ্বের যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য ইশতেহারস্বরূপ। এ কথাগুলো কেবল কবিতায় বললেই হবে না- এ তাগিদবোধ করেছেন কবি। সেই লক্ষ্যেই তার সাংবাদিকতা-সম্পাদকতার সঙ্গে যুক্ততা। কেননা গণমাধ্যম যে কথা যেভাবে যে পরিসরে বলতে পারে এবং বার্তা পৌঁছে দেওয়ায় ভূমিকা পালন করে, তা অন্য কোনো মাধ্যমের পক্ষে সম্ভব নয়, এমনকি রাজনৈতিক পরিসরও সে ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে। এ ভাবনা ও বোধ থেকেই যে নজরুল সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন- তার সাংবাদিকতা সূত্রে পালনীয় ভূমিকা ও লেখাগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখলে সেটা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।

উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলাম সাংবাদিক জীবনের প্রারম্ভে স্বল্পায়ুর পত্রিকা ‘নবযুগ’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ক্ষণিক আলোর রেখায় উদ্ভাসিত হয়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলেও, ক’দিনেই সে তার জাত চিনিয়ে যায়। নবযুগে প্রকাশিত কবির লেখাগুলো ‘যুগবাণী’ নামে যখন বই আকারে বের হয়- ব্রিটিশ শাসক সরকার দ্রুততার সঙ্গে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ‘নবযুগ’ বন্ধ হওয়ার পর নজরুল ‘সেবক’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, কিছুদিনের জন্য। ‘নবযুগ’ ও ‘সেবক’ এর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ নজরুল নিজের একটা পত্রিকার অভাববোধ করছিলেন, গভীরভাবে। সেই সুযোগ হাজির করে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার আবির্ভাব। যেখানে আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নজরুলকে খুঁজে পাই প্রজ্ঞা ও সাহসে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের গভীরতর প্রত্যয়ে।

‘বিদ্রোহী’তে নজরুল যে কথা বলেছিলেন প্রতীক ও রূপকে, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায়, মিথ ও পুরাণে; ধূমকেতুতে এসে সেই কথা বললেন একেবারে সরাসরি, কোনো প্রকার রাখঢাক ব্যতিরেকে।

‘ধূমকেতু’ কবিতায় কবির উচ্চারণ ছিল: ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু/এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু/ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি।’ কবিতার আবেগ ও অভিজ্ঞান এক হয়ে যায় পত্রিকায় জারি হওয়া সম্পাদকয়ীতার সঙ্গে। তখন বাঙালির জাগরণের কাল, যদিও এই সময়ের বেশ আগে থেকে শতবর্ষ ধরে বঙ্গে চলছে নবজাগরণের নবতরঙ্গ। ডেভিড হেয়ার, ডিরোজিও, রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের বিকাশ তখনও চলমান। ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ নামে মান্যতা পাওয়া এ নবজাগরণের একটা বিশেষ দিক ছিল সনাতন ধর্মেরই পুনর্জাগরণ। যার নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন হিন্দু ও ব্রাহ্ম ধর্মের মনীষীরা।

সনাতন ধর্মের নামে হিন্দু সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশে, বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় চেপে বসা কুসংস্কার-কুপ্রথা, উদ্ভট রীতি-নীতি ও শাস্ত্র অননুমোদিত আচার-বিচার দূর করা ছিল এ নবজাগরণের মূল লক্ষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীলতা ও নানামুখী প্রয়াস ও প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় নবজাগরণ যখন পূর্ণতা প্রাপ্তির দ্বারগোড়ায় তখন সেই নবজাগরণের সামনে হাজির হয় নতুন এক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গের ঢাকায় শুরু হয় ঢাকার নবজাগরণ, যা বাংলাদেশের নবজাগরণ হিসেবে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।

লক্ষ্যণীয়, বঙ্গীয় নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা হলো, এক. শুধু হিন্দু ও ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এ নবজাগরণ। দুই. এ নবজাগরণকে বঙ্গীয় নবজাগরণ বলা হলেও এ নবজাগরণের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিন. এ নবজাগরণ মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক এবং তার আশপাশেই সীমবদ্ধ ছিল। চার. এ নবজাগরণ অবিভক্ত বঙ্গের সকল প্রান্তের বিদ্বৎসমাজ ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমুখী ছিল না। পাঁচ. আয়তনিকভাবে অবিভক্ত বঙ্গের বড়ো একটা জনপদ পূর্ববঙ্গ, অথচ পূর্ববঙ্গকে এ নবজাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ছয়. অবিভক্ত বঙ্গের মুসলিম জনসংখ্যা তখন সংখ্যাতিরিক্ত হলেও বঙ্গীয় নবজাগরণের সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য করার মতো সম্পৃক্ততা ছিল না। সাত. বঙ্গীয় নবজাগরণ বঙ্গের দুই প্রধান ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আগে ও পরে আশাপ্রদ কোন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আট. বঙ্গের দুই প্রধান ধর্মগোষ্ঠীর হৃদয়ের বিভাজন রোধে কোনো প্রকার দফারফা করতে পারেনি। নয়. এ নবজাগরণ জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, বাস্তবতা ও প্রায়োগিকতা নিয়ে আশাব্যাঞ্জক কোনো কিছু নির্মাণ করতে পারেনি। দশ. এ নবজাগরণ দেশভাগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেনি।

বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা ও ভিত্তিভূমি তৈরি হয় পূর্ববঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের একাংশ, বিশেষ করে হিন্দু সমাজের নেতৃস্থানীয়রা। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে জন্ম নেয় স্বদেশী আন্দোলন, স্বাদেশিকতা বোধ ও বিপ্লববাদ। যদিও এ আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের তর্ক জারি রয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা, তা নিয়ে কোনো প্রকার দ্বিধা ও সংশয়ের অবকাশ নেই। বাঙালি জাতিয়তাবাদের উন্মেষকালেই দানা বেঁধে ওঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদই সর্বভারতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ততদিনে জন্ম নিয়েছে দু-দুটো রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। জাতীয়তাবাদের এ চেতনা ক্রমশ প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে কলকাতা থেকে দিল্লিতে যায়। পূর্ববঙ্গের ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রতিটি ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখিত হওয়ার মতো, যার সঙ্গে কেবল তুলনা চলে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের।

এসব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত হয় বিশ্ব ইতিহাসের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অধ্যায়। এক. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ; যা ১৯১৪ তে শুরু হয়ে ১৯১৯-এ এসে শেষ হয়। দুই. রাশিয়ায় কমিউনিজমের জয়, যা বলশেভিক বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব হিসেবে সর্বজনমান্য। জারদের হটিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের শাসন ক্ষমতায় আবির্ভাব বিশ্ব ইতিহাসের মাইলফলক ঘটনাবিশেষ। তিন. জাতীয়তাবাদী নেতা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে শুরু হয়েছে আধুনিক তুরস্ক গড়ার আন্দোলন, পতন হয়েছে অটোমান রাজতন্ত্রের।

কাজী নজরুল ইসলাম তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈনিক। আবাসিত হয়েছেন কলকাতায়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে লিখলেন কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। অ্যাকাডেমিশিয়ান, কবিতা প্রেমিকরা এ কবিতার প্রতীক, রূপক, উপম, উৎপ্রেক্ষা, মিথ, পূরাণ, ছন্দ, ভাষাভঙ্গি, শব্দ নির্বাচন, বাঙ্ময়তা, স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে অজস্র-অগণন কথা বলেছেন। আগামীতেও নিশ্চয় বলবেন। কিন্তু এ কবিতার মূল স্বর হলো জাতীয়তাবাদ। ‘বিদ্রোহী’ প্রধানত ও সর্বৈবভাবে জাতীয়তাবাদী কবিতা, যার অন্তর্গত অনুভবে ব্যক্ত হয়েছে দেশপ্রেমের সুর।

১৯২১-র ডিসেম্বরে ‘বিদ্রোহী’ যে জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখেছিল, ৪৭-এর দেশ বিভাগ ও ভারতভঙ্গ সেই জাতীয়তাবাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। বাঙালিকে বিভক্ত করা হয়েছে। হৃদয়ের বিভাজন ঘটিয়ে সেই ভাগকে কেবল পরিণত করা হয়নি, মান্যতাও দেয়া হয়েছে। বঙ্গীয় নবজাগরণের যে চ্যালেঞ্জ ছিল আঁতুড়ঘরেই। সেই চ্যালেঞ্জ উতরানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রচনাকালে যে নবজাগরণের বীজ রোপিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে, যে নবজাগরণের প্রথম পর্বের উন্মেষ ঘটেছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকাকে কেন্দ্রে রেখে। যে নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে পুরোভাগে রেখে। দ্বিতীয় পর্বের এ নবজাগরণ ঢাকায় সংঘটিত হলেও এর সঙ্গে যুক্ত করেছিল পুরো দেশের মানুষকে। এক স্বর ও সুরে গেঁথেছি মাতৃভাষার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ ন্যায্যতার প্রশ্নেই বাঙালি তার নবজাগরণের তৃতীয় পর্বে বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দেয়। ১৯২১-এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আঁকা জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন পূরণ হয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর।

কাজী নজরুল ইসলাম আগাগোড়াই একজন জাতীয়তাবাদী কবি, সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক, সাহিত্যিক, গীতিকার ও সুরকার। নজরুলের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ এক সুলুকসন্ধান মেলে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়, যা অন্য কোনো সম্পাদক কখনো এভাবে ভেবে দেখিয়েছেন কি-না সংবাদপত্রের ইতিহাস পাঠের অভিজ্ঞতায় আমাদের অনুসন্ধানে মেলেনি। পত্রিকাটির বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করত না। এ ব্যাপারে তাদের নীতি পাঠককেও অবহিত করা হয়েছিল। এসবের মূল লক্ষ্যই ছিল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ। বিজ্ঞাপন প্রকাশের ব্যাপারে তাদের ঘোষণা ছিল- এক. দেশের অনিষ্টকর কোনো বিলাতি বিজ্ঞাপন লওয়া হয় না। দুই. মদের বিজ্ঞাপন লওয়া হয় না। তিন. অনাথ, বিধবা ও দেশের জন্য যাঁহারা জেল খাটিয়া আসিয়া সামান্য মূলধনের কারবার করিতেছেন, প্রয়োজন হইলে তাঁহাদের বিজ্ঞাপন বিনামূল্যে প্রকাশ করা হইবে। ধূমকেতুর প্রাণ ছিল তার সম্পাদকীয়র মধ্যে। তার প্রমাণ মেলে একই সময়ে প্রকাশিত দ্বিভাষীয় পত্রিকা অমৃতবাজার-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে।

নজরুলের আপসহীন জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে ভীত হয়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার শুরু থেকেই নজর রেখেছিল ধূমকেতুর ওপর। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বরের বারোতম সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয় নজরুলের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। দীর্ঘ এ কবিতার প্রথম কয়েক চরণ হলো- ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।/দেশশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূভারত আজ কসাইখানা-আসবি কখন সর্বনাশী?/দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,/রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই এলে কৃপাণ ধরে?’ ব্রিটিশ সরকার এ সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে পরের দিন কলকাতায় আনা হয়। ২৫ নভেম্বর কোর্টে নেওয়া হয়, ২৯ নভেম্বর পড়ে মোকদ্দমার দিন। বিচার চলাকালে নজরুল অনশন করেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও বিচলিত করে এবং তিনি অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠান, যা পৌঁছে না দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ প্রশাসন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে ফেরত পাঠায়। বিচারে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারতে তো বটেই, ব্রিটিশ উপনিবেশে প্রথম কোনো কবিকে কবিতা লেখার জন্য কারান্তরীণ হতে হয়। নজরুলের কারান্তরীণের মধ্য দিয়ে ধূমকেতুর ভাগ্যেও নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ১৯২৩ সালের মার্চে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। তার আগে প্রকাশিত হয় নজরুল সংখ্যা। যেখানে স্থান পায় কবির রাজবন্দীর জবানবন্দী লেখাটি।

নজরুল ধূমকেতুর উদ্বোধনী সংখ্যায়ই স্পষ্ট করেন তার অভিপ্রায়। তিনি লেখেন : ‘রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়েই আমাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সেই তার ভয় পায়। আমার বিশ্বাস যে নিজেকে চেনে, তার আর কাউকে চিনতে বাকি থাকে না। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না- অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না।’ জাতীয়তাবাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত না হলে এভাবে বলা যায় না, সম্ভবও না। ‘বিদ্রোহী’র নজরুলের পক্ষে এভাবে বলা ও লেখা সম্ভব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত