ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ত্রিপুরা সংস্কৃতির জীবনদর্শন

বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও শায়লা আহমেদ
ত্রিপুরা সংস্কৃতির জীবনদর্শন

ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য অঞ্চলের ত্রিপুরাদের মতো বাংলাদেশে বসবাসরত ত্রিপুরাদেরও রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি। এই অনুষ্ঠানাদির অন্যতম দিক হচ্ছে পারফর্মিং আর্টস বা নৈপুণ্য প্রদর্শনী শিল্প। ঐতিহ্যবাহী এসব নৈপুণ্য প্রদর্শনীর মধ্যে নিহিত রয়েছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দর্শন ও দিকনির্দেশনা, যা অনুসরণ করে এবং প্রাত্যহিক জীবনে যেগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে করতে পারি সমৃদ্ধ ও পরিশীলিত। এ নিবন্ধে সেই জীবন দর্শন ও নির্দেশনার ওপরই আলোকপাত করা হয়েছে।

কাথাররক মাসানায় বা মাঙ্গলিক নৃত্য : কাথাররক মাসানায় বা মাঙ্গলিক নৃত্য ‘বোতল নৃত্য’ নামেই বেশি পরিচিত। জনপ্রিয় ও দৃষ্টিনন্দন এই নৃত্য সাম্প্রতিককালের মঞ্চ সংস্কৃতির যুগে বেশ প্রতিপত্তির আসন দখল করেছে এবং সুপরিচিতি অর্জন করেছে। কিন্তু মূলত এই নৃত্য ত্রিপুরাদের জীবনঘনিষ্ঠ এবং সামাজিক জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমৃদ্ধ পরিবারগুলোর বিয়ে অনুষ্ঠানে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয় অনেকটা প্রতিযোগিতার ভঙ্গিতে এবং সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ কামনায়। বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ দুই দলের নৃত্যশিল্পী এই নৃত্য পরিবেশন করে অনেক ভারসাম্যসূচক উপকরণ সহকারে। শিল্পীদের প্রত্যেকের দুই হাতে থাকে দুটি থালা, মাথায় একটি মদপূর্ণ বোতল যার শীর্ষে থাকে একটি প্রজ্বালিত মোমবাতি। বাঁশির সুরে সুরে কাথাররক মাতাই এবং সমবেত দর্শকদের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন শুরু করেন। নৃত্য পরিবেশনের পুরোটা সময় তাদের হাতে থালা এবং মাথায় বোতল ধারণ করে রাখতে হয়। বিভিন্ন তাল-লয়ে নৃত্য-নৈপুণ্য প্রদর্শনের একপর্যায়ে শিল্পীরা জলপূর্ণ কলসির ওপর আরোহণ করে এবং কলসির ওপর ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মুদ্রার নৃত্য পরিবেশন করেন। সর্বশেষে কলসির ওপর এক পায়ে দণ্ডায়মান অবস্থায় মাথায় প্রজ্বালিত মোমবাতি সমেত মদপূর্ণ বোতল ও দুই হাতে দুটি থালা ধারণ করে রেখে ভারসাম্যের উত্তম উৎকর্ষ প্রদর্শন করা হয়।

ত্রিপুরারা বিশ্বাস করেন, যে পক্ষ এই চারটি উপকরণের ভারসাম্য বজায় রেখে অধিকক্ষণ নৃত্য প্রদর্শন করতে পারবে, কাথাররক দেবতার আশীর্বাদে সে পক্ষই পারিবারিক জীবনে নেতৃত্ব দান করবে। কীভাবে এই নেতৃত্ব ও প্রতিপত্তি অর্পিত হয়, তার এক বিশাল তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ নৃত্য, নৃত্যের উপকরণ ও সেগুলোর ভারসাম্য ধরে রাখার মধ্যে।

প্রজ্বালিত মোমবাতি হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক, মদপূর্ণ বোতল হচ্ছে সম্মান ও ক্ষমতার প্রতীক, থালা হচ্ছে ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রতীক আর জলপূর্ণ কলসি হচ্ছে স্থিতিশীলতা ও কল্যাণের প্রতীক।

আমাদের জাগতিক জীবনে বা পারিবারিক জীবনে নেতৃত্বের জন্য এই চারটি উপকরণ আবশ্যিক এবং এই উপকরণগুলোর অর্থাৎ জ্ঞান, ক্ষমতা, ধন-সম্পদ ও কল্যাণ চিন্তা/স্থিতিশীলতা এগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। যাদের এই উপকরণগুলো আছে এবং যারা এগুলোর সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে পারিবারিক জীবনে এবং সামাজিক জীবনে তারাই নেতৃত্ব অর্জন করে।

ক্রম গুরুত্বের দিক দিয়ে জ্ঞানের স্থান হচ্ছে সবার ওপরে। তারপর রয়েছে সম্মান বা ক্ষমতা; তৃতীয় স্থানে ঐশ্বর্য। আবার জ্ঞান, ক্ষমতা, ধন-সম্পদ- এসবই পরিচালিত হতে হবে কল্যাণের উদ্দেশ্যে।

বাংচুচু বাংগ্রাই গ্রাই : একটি শিশুতোষ ছড়া : এ রকম অনন্য শিক্ষা-দর্শনের আরেক রত্ন ভান্ডার হলো জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ ছড়া, যেটা খেলাচ্ছলে শিশুদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। স্মরণাতীতকাল থেকে প্রচলিত এই ককবরক ছড়াটি হতে পারে কিন্ডারগার্টেন স্কুলিং বা খেলাচ্ছলে পড়াশোনার একটি চিরন্তন (দ্রৌপদী) উদাহরণ।

এই ছড়া উপস্থাপনের জন্য মা-বাবারা বা শিশুদের যত্নকারীরা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের ওপরে শিশুদের বসায়। তারপর পা নাচিয়ে শিশুকে দোলনার মতো দুলিয়ে দুলিয়ে ছড়াটি উপস্থাপন করেন- ‘বাংচুচু বাংগ্রাই গ্রাই/আসরাই বফাং কাঃদং/মান্দার চপারা চপ্রদং/মুইফারাই বুদুকবায় নক খাদং/তক্তুই বখলং বাই নক তাংদং/মুইতক বকংবায় সংসাদং/ওয়াতোয়-নবার ফাইদং/বারোং মাতাই মাসাদং/অ- অ- অ বজাং কালাইন/বজাং কালাইয়া/গাম খাইয়ই নাইদি দ।’ ‘অ- অ- অ রাংচাক বুলুংগ’ কালাইখায়/রাংচাক খলই লাদি, /রুফাইন বুলুংগ কালাইখায়/রুফাইন খলই লাদি, /অওয়ান বুলংগ কালাইখায়/অওয়ান খলই চাদি।’ ‘তকখি বুলংগ কালাইখায়/তকখি বুলজাকনায়, /ওয়াকখি বুলংগ কালাইখায়/ওয়াকখি বুলজাক নায়- /মেনাম মেনাম মেনাম!’

খেলাচ্ছলে এই ছড়া শিশুদের কাছে বিনোদন সহকারে এমন অসংখ্যবার উপস্থাপন করা হয় যে, প্রতিটি শিশুই সারাজীবন ছড়াটি মনে রাখতে পারে। কিন্তু যে বিষয়টি বরাবর আড়ালে থেকে যাচ্ছে বা মিস হয়ে যাচ্ছে তা হলো, এই ছড়ার ভেতরে লুকায়িত অনন্য শিক্ষা যা হতে পারত শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের জন্য বা জীবনযাপনের জন্য এক অমূল্য দর্শন। সেই উদ্দেশ্যে ছড়াটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বড়বেলায় অর্থাৎ কৈশোরের শুরুতে আর একবার ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। নিম্নে আমরা সেই তাৎপর্যটি বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নিচ্ছি।

আমাদের জীবনটা হচ্ছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় বেয়ে ওই কাঠবিড়ালিটির বা টাকি মাছের বৃক্ষ আরোহণের মতো। ঝড়ের দোলায় আন্দোলিত গাছ থেকে কোথায় গিয়ে পতিত হই সে ব্যাপারে সদা সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। ‘রাংচাক বুলংগ’ ‘কালাইখায়’ যদি স্বর্ণস্তূপে পড়ে যায় তাহলে আমরা স্বর্ণ কুড়িয়ে নিতে পারব।

অনুরূপভাবে আমরা আমাদের কর্মদক্ষতা, সচেতনতা অনুযায়ী একটি রুপালি জীবন, সমৃদ্ধ জীবন পেতে পারি। তাই সদা সতর্ক ও সচেতন থেকে লক্ষ্য স্থির রেখে সম্মুখস্থ প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে প্রত্যাশিত সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে হবে। ‘তকখি বুলুংগ কালাইখায়, /ওয়াকখি বুলুংগ কালাইখায়, / মেনাম মেনাম মেনাম!’ ‘মুরগির বিষ্ঠায় পড়ে গেলে, /শুকরের বিষ্ঠায় পড়ে গেলে, /দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে।’

গত্যন্তরে, আমরা যদি অসচেতন হই, অবহেলা করি বা জেনে-শুনে পুঁতিময় দুর্গন্ধযুক্ত স্থানকে বেছে নিই বা গন্তব্যে পৌঁছি অর্থাৎ কুসঙ্গঁ, কুকর্ম বা জীবনের অন্ধকারদিককে বেছে নিই, তাহলে জীবনটা হবে অন্ধকারময়, দুর্গন্ধযুক্ত, গ্লানিময়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত