ছোটোকাগজ সম্পাদকের সাতকাহন...
আনোয়ার কামাল
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদক। হ্যাঁ। ছোটোকাগজের সম্পাদক। একে আপনি লিটল ম্যাগাজিন, বারুদখানা, ছোটোকাগজ, সাহিত্যবিষয়ক ছোটোকাগজ যে নামেই ডাকুন না কেন, এর একটা ঝাঁজ আছে। অন্যসব দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক কিংবা সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকের চাইতে এই যে বললাম বারুদসম ছোটোকাগজগুলোর সম্পাদকের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর সে তার মতো করেই নিজস্ব একটা আবহ নিয়ে বলয় তৈরি করে। এটাকে বলয় বলছি কেন? তারও একটা মজেজা আছে। এই যে বললাম ছোটোকাগজ। হ্যাঁ, ছোটো ওই আকারে আর গায়ে গতরে আর কি! তবে এটাও সত্য কেউ কেউ সব কিছুকে ছাপিয়ে ঢাউস আকারের দুই-চারটি যে বের করছে না, তা কিন্তু নয়। সেটাও বেরুচ্ছে। তবুও তার নাম কিন্তু সেই ছোটোকাগজ বলেই চিহ্নিত হচ্ছে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে প্রথাগত ধারার বাইরে নতুনের কেতন ওড়ানোর মানসিক বিন্যাসে ছোটোকাগজের জন্ম হয়ে থাকে। সেই ছোটোকাগজটি কালের আবর্তনে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, আবার বেশিরভাগ কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। এই টিকে থাকা আর হারিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে ছোটোকাগজ তার অমিত স্পর্ধার জানান দিয়ে যায়। ছোটোকাগজ স্বনামে বেড়ে উঠলেও এখনকার ছোটোকাগজগুলো কিন্তু আর আদৌও ছোটো নয়। তার ব্যাপ্তি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি যদি বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীর কাগজের কথাই বলি, সেখানে দেখতে পাব আমাদের অগ্রজ-অনুজ-সমবয়সী। বন্ধুরা প্রবাসে বসেও বাংলা ভাষার কাজগগুলোকে বিশ্বায়নের এই যুগে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার সেই পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে অনেকটা অগ্রসর হয়ে বছরের পর বছর পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখছেন। বর্তমানে যেমন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে লেখা সংগ্রহ ও সংরক্ষণেরও। এসব কারণে বেশ বড় বড় আকার আকৃতির ওজনদার পত্রিকাও বের হয়ে আসছে হরহামেশা। আবার বয়সের কথা উঠলে বলা হয় কেবল তরুণরাই এসব বের করে থাকে। আবার এক সময় বন্ধও হয়ে যায়। বিষয়টা সর্বৈব সত্য নয়। এসব কাজের বয়স নিয়ে বিষয় নির্ধারণ করা যাবে না। ছোটোকাগজগুলো সবসময় তারুণ্যনির্ভর হয়ে থাকে। সেই তারুণ্য কোনো বয়সের ছাঁচে বাধা নয়। একজন তরুণের ভেতর যে ধরনের তারুণ্য থাকে, আবার একজন সাহিত্যকর্মীর ভেতর যুবক, মধ্য বয়স এমনকি পৌঢ় বয়সেও সেই তারুণ্য থাকতে পারে, যদি সে তারুণ্যকে তার কাজেকর্মে ধরে রাখতে পারেন। কাজেই ছোটোকাগজ বের করার বা সম্পাদনা করার কোনো গৎবাঁধা বয়সসীমা নেই। সেই ছোটোকাগজ বর্তমানে তার শরীরে মাংস বৃদ্ধির মতো ফুলে ফেঁপে ঢাউস আকারের অনেক কাগজ আমরা হাতে পাচ্ছি। বাণিজ্যিক কাগজের সঙ্গে ছোটোকাগজের রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। বণিজ্যিক কাগজের যেখানে রয়েছে মত প্রকাশের সীমাবব্ধতা, সেখানে ছোটোকাগজ অনেকটা বেপরোয়া। যেন খাপখোলা তলোয়ার। এই কারণেই বেপরোয়া লাগামহীন বলছি যে, তাকে আটকানোর, তার মত প্রকাশে বাধা দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ নেই। তার কোমরে দড়ি দিয়ে পিছনমুখে টেনে ধরে রাখবে এমনটি হবার নয়। আবার ছোটোকাগজের সাহসী সম্পাদকরা এসবকে তোয়াক্কাও করে না। ফলত, লাগামহীন-বাধাহীন খাপখোলা তলোয়ারের মতো নতুন লিখিয়েদের কলমের খোঁচায় তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে ছোটোকাগজগুলো। ছোটোকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন মূলত প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাহক ‘প্রতিষ্ঠান’-এর পাঁচিলকে ভেঙে নতুনকে আহ্বান, নতুন সৃষ্টি, নতুনে অবগাহন। আবার নতুনকে ভেঙে আরেক নতুনে প্রত্যাগমন। সীমিত প্রচার সংখ্যায় প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থি; ক্ষণআয়ু। লিটল ম্যাগাজিন সংশ্লিষ্টদের বা একদল সমমনাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি ছোটোকাগজ। নিজেদের মধ্যে মতবিনিময়, চিন্তার আদান-প্রদান করার চিন্তা থেকে, ব্যবসার জন্য নয়। তরুণ অপরিচিত লেখকের লেখা ছেপে জানান দেওয়া, তাকে লেখক হিসেবে তুলে ধরা, তার চিন্তার স্ফূরণ ঘটানো। মুক্তমনা কিছু তরুণের ভাবনার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়ার বিক্ষণে ছোটোকাগজকর্মীরা সচেতনভাবে, অকুণ্ঠচিত্তে নির্মোহভাবে অলাভজনক এ ধরনের কাগজ বের করে থাকে। এসব কাগজ কবে কোথায় বেরিয়েছিল তারও একটা ইতিহাস ঘাঁটা একটু প্রয়োজন রয়েছে বৈকি! সেই লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম ইতিহাসের ভেতর দিয়ে তার বেড়ে ওঠার যে ইতিহাস সেটাই জানান দেয়- বিস্ফোরিত বারুদ কতটা সুতীব্র চিৎকারে জানান দিতে পারে। বিশ শতকের শুরুতে আমেরিকায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয় আমেরিকান বিপ্লবের প্যাম্ফলেট হিসেবে। ১৮৪০ সালে বোস্টনে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় লিটল ম্যাগাজিন। শুরুতে এরা নিজেদের প্রকৃত চেহারায় আবির্ভূত হয়। ১৮৪০-১৮৪৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয় ‘দ্য স্যাভয়’। এ পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে ছিলেন আর্থার সাইমন্স। ভিক্টোরিয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার উদারপন্থি ও সাম্যবাদী লেখকদের প্রধান বাহন ছিল এ পত্রিকাটি। আমাদের দেশেও মুক্তচিন্তক, প্রগতিচেতনার ধারক বাহক কবি লেখকদের মধ্যেও এসব লিটল ম্যাগাজিন বের করার প্রবণতা দেখা দেয়। লিটল ম্যাগাজিন বলতে আসলে আমরা কী বুঝে থাকি? লিটল ম্যাগাজিন বা যাকে আমরা বাংলায় বলি ছোটোকাগজ, সেই ছোটোকাগজ কি কারণে ছোট? আর কোন সংজ্ঞায় ছোট? এর মাত্রা মাপক কোনো যন্ত্র আছে কী? ছোটোকাগজ বলা হচ্ছে এর আকার আকৃতির কারণে, নাকি অবজ্ঞা-অবহেলার কারণে, বা বোধশক্তির অভাবের কারণে, তাও ভাববার খোরাক জোগায়। ১৯৫৩ সালের মে মাসে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘সাহিত্যপত্র’ এক প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর লেখাটি প্রণিধানযোগ্য। “এক রকমের পত্রিকা আছে, যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই, যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত ও বিব্রত করেন। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার আমাদের হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে দেখে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিনগন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি, জল, পোকা আর অপহারকদের আক্রমণ থেকে বাঁচাবার জন্যে। যেসব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়, কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাঁদের উঁচুর দিকে, তাঁদের জন্যে নতুন একটা নাম বেরিয়েছিল মার্কিন দেশে, চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে- ‘লিটল ম্যাগাজিন’।” বাংলা কবিতায় লিটলম্যাগের প্রসঙ্গ এলেই সর্বাগ্রে আমরা বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার কথা স্মরণে আনতে পারি। আবার অনেকে এ ‘কবিতা’ পত্রিকাটিকে লিটল ম্যাগাজিন মানতে চাননি। একে একটা উৎকৃষ্টমানের সাহিত্য পত্রিকা বলেছেন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন যে সমস্ত কমিটমেন্ট দাবি করে তা তাতে নাকি ছিল না। এ ধরনের বিস্তর আলোচনা হতেই পারে। ‘কবিতা’ পত্রিকাটি একটি উন্নমানের সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে ছিল। সাহিত্য পত্রিকা তাও হতে পারে। লিটল ম্যাগাজিনকে কেবলমাত্র লেখার জন্যই না, একে একটি আন্দোলন হিসাবেও ধরা হয়, যা এক শ্রেণির বোদ্ধা পাঠক এ কথাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকেন। আবার আমরা যদি কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় লিটল ম্যাগাজিন এর স্থায়িত্বকালকে বিচার করতে যাই, তবে তিনি কি বলেছেন দেখি। তাঁর ভাষায় : ‘এক দশকেই সঙ্ঘ ভেঙে যায়। দশক যায় দশক আসে। সঙ্ঘ ভাঙে সঙ্ঘ গড়ে।’ এই ভাঙা-গড়ার মাঝেই নতুন নতুন লিটল ম্যাগাজিন জানান দেয়, আসে যায়, কেউ কেউ চেতনায় গেঁথে থাকে অনেকদিন ধরে। কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, তা কিন্তু নয়। অনেকেই আমৃত্যু লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছেন, বৈরাগ্য বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিন শব্দটির সঙ্গে আরো একটি শব্দ জড়িত। সেই শব্দটি হলো আন্দোলন। কী সামাজিক আন্দোলন কী শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। কারণ, সামাজিক আন্দোলনগুলোও কখনো কখনো সাহিত্যের স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়। সামাজিক আন্দোলনগুলো লেখকদের কাছে টানে, তাদের বলে দিতে হয় না, কি করতে হবে। লিটল ম্যাগাজিন এর প্রধান কাজই হচ্ছে নতুনের কেতন উড়ানো। আর তাদের তুলে আনা, সমাজের অলি-গলি থেকে সাহিত্যকর্মীরা বেরিয়ে এসে প্রথার বিরুদ্ধে নতুন ধরনের স্ট্যান্ড নেয়া; করপোরেট বাণিজ্যের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
লিটল ম্যাগাজিনগুলো ঝরে যেতে পারে, আর্থিক দৈন্যতার করাল গ্রাসে; কিংবা করপোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দৌড়ে তাকে কচ্ছপ গতিতে দৌড় দিতে হয়। তার পরেও বলব লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা ভেঙে গেলেও মচকায় না। যার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে, কিংবা দেশের ভেতরের অন্যায়ের প্রতিবাদে কিংবা বর্হিবিশ্বে কোনো আগ্রাসী শক্তির অন্যায় পদক্ষেপের প্রতিবাদে, এই লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটোকাগজের কর্মীরা পিছপা হয়নি। তারা এসব ছোটোকাগজে প্রথমে মিউ মিউ করে বললেও আসল সময়ে প্রবল প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত হয়েছে। তারা প্রয়োজনে রাজপথে নামতে পিছপা হয় নাই। আবার এক শ্রেণির বিপথগামী তরুণকে লিটল ম্যাগাজিনের ছায়াতলে সমবেত করে, সম্পৃক্ত করে তাদের সঠিক পথের দিক নির্দেশনাও এসব ছোটোকাগজ কর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
পাশাপাশি এসেছে আদর্শিক চিন্তা-চেতনার স্ফুরণ বিকাশ করাতে লিটল ম্যাগাজিন হাতিয়ার হয়ে কাজ করেছে, যা পারে না কোনো করপোরেট বাণিজ্যিক কাগজের সাহিত্য সম্পাদক। তাকে অনেক দায়বদ্ধতার নাগপাশে আবদ্ধ থাকতে হয়। তাকে কেবলই নিছক সাহিত্য ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হয়। মালিকের দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক গোষ্ঠীর বা বলয়ের ভেতরের লোকদের নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে, কাজের কাজটি কাজীকে দিয়ে বেশিরভাগ সময় করানো যায় না। তার পরে পাতায় জায়গার অপ্রতুলতার দোহাই তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে বলতে গেলে লিটলম্যাগ সম্পাদক স্বাধীনভাবে মত ও পথের দিশা দেখাতে পারে। তার পত্রিকায় যে কোনো ধরনের লেখা বা মতামত প্রতিফলন করানো যায়। ছোটোকাগজের সম্পাদকরা মফস্বলের অপরিচিত, অবহেলিত লেখককে তুলে আনতে পারে অবলীলায় এবং তারা সে কাজটি নিপুণভাবে করে যাচ্ছে, যা কোনো দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য প্রয়োজন পড়ে না। বা তারা সে কাজটি করবার জন্য ব্যস্ত প্রস্তুতও নয়।
লিটলম্যাগ সম্পাদকদের নানাজনের নানান রকম চিন্তার খোরাক রয়েছে। কিন্তু সেই চিন্তার খোরাকগুলো প্রকৃত বিচারে আমরা যদি এক কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারি। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিন্তার বিষয়গত দিক মিলেও যায়, ফলে সামগ্রিক চিন্তাগুলো প্রগতিশীল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে শামিল হয়। সেই সব চিন্তা-চেতনার ফলাফলে আশির দশকে এবং নব্বই এর দশকে অনেক কাগজ বেরিয়েছে। বর্তমান সময়েও অনেক কাগজ বেরুচ্ছে। যার মধ্যে অনেক কাগজ পাঠকপ্রিয়তাও পেয়ে গেছে। আবার যারা আট এর দশকে কিংবা নয় এর দশকে জানান দিয়ে পত্রিকা করেছে, তারা অনেকেই ঝিমিয়ে গেছে, থিতু হয়েছে। অনেকে আবার হারিয়েও গেছে। নেশা ছুটে যাওয়ার মতো আর কি। তবুও কারো কারো নেশা যে ছোটে না, বুঁদ হয়ে ঝিম মেরে থেকেও আজান দিয়ে মাঠ সরগরম করে বৈকি।
আট দশকের বা নয় দশকের কেউ কেউ আবার তাদের পিচ্ছিল পথে হাঁটা বোধহয় দুর্গম হয়ে পড়েছিল। ফলত, অনেক দিন তাদের মুখ দেখা যায়নি। বলতে গেলে ভাটা পড়েছিল। সুখের বিষয়, আনন্দের বিষয় হলো আবার তাদের মধ্যে অনেকেই গা-ঝাড়া দিয়ে খাড়া হতে দেখা যাচ্ছে, জোয়ার এসে প্লবিত করে নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় নিজেদের পাখির ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতে দেখা যা”েছ। এ ছাড়া নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে এ প্রজন্মের তরুণরাও কাগজ করছেন। এটি যেমন আনন্দের বিষয়, পাশাপাশি গৌরব করবার মতোও বটে। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন এগিয়ে যাক। রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে জেলা-উপজেলায় লিটল ম্যাগাজিন ছড়িয়ে পড়ুক। প্রতি জেলা-উপজেলার পাঠাগারগুলোতে লিটল ম্যাগাজিন কর্ণার গড়ে উঠুক। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব গড়ে তোলা হোক। বইমেলার মতো প্রতিবছর লিটল ম্যাগাজিন মেলার আয়োজন করা হোক। এ দাবি আমরা করতেই পারি।
এ তো গেল এক দিকের কথা- এবার আসা যাক এই ছোটোকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন বের করবার যাতনার কথা, বিড়ম্বনার কথা, যা একজন ছোটোকাগজ সম্পাদককে কী ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে! কি ধরনের যন্ত্রণার পরাকাষ্ঠে নিমজ্জিত করে। লেখা সংগ্রহ থেকে শুরু করে, প্রেসের গুপ্ত পথ থেকে একটি পত্রিকা আলোর মুখ দেখতে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত- একজন সম্পাদককে কতটা বেদনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়- তা কেবলমাত্র সম্পাদকমাত্রই জানেন। পাঠক তো ঝকঝকে, তকতকে রঙের বাহারি কিংবা সাদাকালোর ঝলকানিতে যে পত্রিকাটি হাতে তুলে নেন, তার ভেতরের অন্তবেদনার কান্নার কি কিছু শুনতে পান। নিশ্চয় না।
আমি আমার অভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞান থেকে দেখছি- অনেক নামকরা লেখক এসব ছোটোকাগজে লেখা দিতে নাক সিটকান। অথচ যদি খোঁজ নেয়া যায়- তবে দেখা যাবে তিনি লেখক হিসেবে বিখ্যাত-প্রখ্যাত হয়েছেন এমন তরো পত্রিকায় হাতেখড়ির মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ লেখক সম্মানীর প্রত্যাশা করেন। পান না দেখে লেখা দিতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ নতুন লেখা- সময়, মেধা শ্রম দিয়ে এখানে লিখতে চান না। আগে প্রকাশিত লেখা, দায় সারা গোছের লেখা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আমি অনেককে দেখেছি অনেক পরিশ্রম করে নির্দিষ্ট পত্রিকার চাহিদা মোতাবেক নান্দনিক একটি লেখার অবতারণা করেন। এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখাটি পৌঁছে দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেন। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের কাছে তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন।
পত্রিকা বের করার পেছনে লেখা সংগ্রহের পরেই যে রসদের প্রয়োজন তা অনেকেই ভাবনার ভেতর নেন না। কেন নেন না? তার কারণ বলি- অনেকেই লেখা দেওয়ার পর পরই খোঁজ নিতে শুরু করেন- পত্রিকা বের হয়েছে কি-না? একটা পত্রিকা বের করতে যে রসদ দরকার, তার জোগান দিতে সম্পাদক বা তার আশপাশের লোকজনদের হিমশিম খেতে হয়। নাকানিচুবানি খেতে হয়। পকেট গড়ের মাঠে পরিণত হয়, বেতনের টাকা, স্ত্রীর কাছে জমানো টাকা নিতে হয়, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে হাত পাততে হয়। এমনকি স্ত্রীর গহনা পর্যন্ত বিক্রি করে এর ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। এর কতটুকুই বা জানেন বিদগ্ধ পাঠককুল। কারণ, এসব কাজে কোনো প্রেসও বাকিতে দেয় না। কিন্তু কেন? এসব করার দরকার কি? সম্পাদকের কিসের ঠ্যাকা? সে এক বাতিক। এক বোধের যাতনা- সম্পাদককে কুঁরে কুঁরে খায়। তাকে প্রসব বেদনার মতো যন্ত্রণায় আকীর্ণ করে। তারপর নবজাতকের মতো সুতীব্র চিৎকারে ভূমিষ্ঠ হয় একটি নতুন সংখ্যা। সম্পাদক ও তার পাশের সহযোগীদের চোখেমুখে তখন পরম তৃপ্তির একটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী, প্রথাবিরোধী বলে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বেড়ে ওঠা ছোটোকাগজের সম্পাদকরা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য ধরনা দেন না। তারপরেও পত্রিকাটিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কিংবা খানিক আর্থিক সংকুলানের জন্য হলেও কারো না কারো কাছে তাকে যেতেই হয়। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়- এসব পত্রিকা তো সাধারণ পাঠকের কাছে যায় না। আপনারই লেখেন, আপনারাই পড়েন। এখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কী লাভ? এক বাক্যে এ কথাটি বলে বিদেয় করে দেন। সম্পাদককে বিমর্ষ মনে ফেরত আসা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না।
লেখা সংগ্রহ নিয়েও বিস্তর দুর্ভোগ রয়েছে। বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা করলে- চাইলেন লেখা? লেখক বললো- ভাই আমি তো কোন বাঁধাধরা বিষয়ে লিখতে পারি না বা লিখি না। চাইলেন সুতন্বীএমজে ফন্টে তিনি তার তোয়াক্কাই করলেন না। পাঠালেন ইউনিকোডে। কারণ, ফেসবুক থেকে কপি-পেস্ট করে তুলে পাঠানোর মতো সহজতরো কাজটি আর কি আছে। এতে যে সম্পাদককে লেখাটা সুতন্বীএমজে ফন্টে কনভার্ট করে নিতে যে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়, যে যাতনা ভোগ করতে হয়, তার খোঁজ তো কেউ রাখে না।
পত্রিকা ছাপা শেষ- এখন লেখকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া সম্পাদকের প্রধান দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে বর্তায়। সেখানে একটা পত্রিকা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো খরচ নিদেনপক্ষে চল্লিশ টাকা ব্যয় করতে হয়। সবশেষে এই খরচটা করতে না পারলে বা সেই সংখ্যার লেখকদের হাতে পৌঁছে দিতে না পারলে- সম্পাদকের সকল শ্রম প- হয়ে যায়। সব পরিশ্রম বৃথা বলে মনে হয়।
আবার পত্রিকাগুলো শহরের বা দেশের কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত বই এর দোকানে বিক্রির জন্য রাখলে যাও কিছু বিক্রি হয়, তার বিক্রীত মূল্য সম্পাদক ঠিকমতো পায় না বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। তবে হ্যাঁ, বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বর নামে একটি স্থান নির্ধারণ করা থাকে। সেখানে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করলে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। লিটলম্যাগ চত্বরে লেখক-সম্পাদকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এখানে লিটল ম্যাগাজিন যা বিক্রি হয়, সে টাকাটা সম্পাদক পেয়ে থাকেন। পরিশেষে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এইসব ছোটোকাগজের ছোট ছোট মেধার সমন্বয়ে যে আমি আপনি আজ কবি, লেখক হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিতি পাচ্ছি বা মানুষ আমাদের লেখক হিসেবে চিনছেন- এর পেছনের কারিগর কিন্তু সেই ছোটোকাগজের সম্পাদক বা লিটল ম্যাগাজিনের বারুদ জ্বালানো সৃষ্টিশীল কাজের খুদে সেই যুবকটি। এ কথা হয়তো অনেকেই ভুলে যান! তবে যারা মনে রেখে স্বীকার করেন, একদিন এইসব ছোটোকাগজে লিখে তিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন- তখনই একজন সম্পাদক এই পরিশ্রমের স্বার্থকতা খুঁজে পান।