অন্তঃশীল ও একটি চুক্তিবিন্যাস

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সে। কানে হেডফোন। এলভিসপ্রিসলির গান। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ডোরবেলে কর্কশ আওয়াজ। সে উঠে বসল। খাট থেকে নেমে দরজা খুলতেই মদ্যপ মুখটা তার মুখের কাছে এসে জড়ানো কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে, না!’ বলেই দরজাটা ধপাস করে বন্ধ করে দিল। সে নিরুত্তর।

সৌমেন এমনই। অফিস শেষ করে রোজ বারে ঢোকে। দুপুর কিংবা মাঝরাত। গাঢ় নীল ঘরটার এক কোণে একটা টেবিল-চেয়ার খালি থাকে তার জন্য। একটানে কয়েক পেগ। কোনদিন এক বোতল, কোনোদিন দুই বোতল। তারপর কোনো সময় বমিটমি। কোনো সময় রাস্তায় চিত হয়ে পড়ে থাকা। কোনো সময় অত-অত করতে করতে ঘরে ফেরা। আজ শনিবার। আজও গিয়েছিল। সুমিত্রার সয়ে গেছে এসব। কিছুই মনে হয় না এখন। পুলিশ শতবার ফোন দিয়ে বললেও মদ্যপটাকে আনতে তার দায় ঠেকে না। অচেনা কেউ বাসায় আগলে নিয়ে এলে ধন্যবাদটুকুও তার মুখ দিয়ে বের হয় না। সৌমেন জানে। টুঁ শব্দটি করে না। মাঝে মাঝে নিজের ঘুমানোর ঘরটায় বিকট চিৎকার করে, চেচামেচি করে, সিগারেটের পর সিগারেট টেনে ধোঁয়া উড়িয়ে ঘরটা কয়লা কারখানার চিমুনির মতো করে তোলে। সুমিত্রা উঁকিও দেয় না সে ঘরে। এই দালানের অনেকেই জানে চার তলায় এক মদ্যপ থাকে। তার সঙ্গে এক অনন্য তরুণী। কানাকানি হয়। আড়চোখ উৎপাত করে। তরুণীটি টের পায়। মদ্যপটা তা উড়িয়ে দেয় ফুঁ দিয়ে। কখনো তার স্বরে বেজে ওঠে মরমি গান, কখনো ক্লাসিক যেন বসন্তে ঝরা কোনো পাতার বাঁশি। একই হাঁড়িতে রান্না হয়। টেবিলে খাওয়া হয়। টিভি সিরিয়াল শুরু ও শেষ হয়... জলের জগ একটা, গ্লাস যার যার। বিছানার চাদর বদল হয় না অনেক দিন। কিশোর ক্লিনার ড্রেনে প্রতিদিন দেখে প্রোটেকশনের ছেঁড়া প্যাকেট। ছানা ভরা চোখ, কোন ঘরে থেকে এতদূর আসে ওসব ডটেড বস্তু! তার ইচ্ছা জাগে। সঙ্খনীর ফণা, ভেতরের ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পায় তার লিকলিকে দেহ, নিজেকে দমন করতে সে ঢুকে পড়ে পাশের কোনো নির্জন আড়ালে। ছুটির দিন বিকেলে তরুণ যুগলেরা এক এক দিক থেকে হাঁটতে নামে হাউজিং মাঠে। শিশুরা খেলে, বয়স্করা টুকে টুকে চলে। পূর্বপরিচিতরা নানান গল্প করে। সুমিত্রা এখানে অপরিচিত। কখনো তার নামা হয় না ফ্ল্যাট থেকে। জানালা দিয়ে সে তাকিয়ে দেখেছে মাঠটা অনেকদিন। সৌমেন সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে উপড়ে ওঠে, নামে। কেয়ারটেকার নৃপেণ বুঝে যায় সন্ধ্যাভ ঝিঁঝির পাখা ঝাপটানো দেখে। কে যেন তার ছোট্ট সিঁড়িঘরে রেখে যায় জোছনার জুস। পূর্ণিমার হাসি। সে ফার্মেসি থেকে ঘুরে আসে নিয়ম করে। মাঝে মাঝে নৃপেণের ডাক আসে ঘন দুপুরে, মাঝে মাঝে রাতের দ্বিতীয় ভাগে। মেঘের ডাকে বৃষ্টিকে নামতে হয়, বৃষ্টির সঙ্গে মেঘের ওয়াদা। মেঘ জানে, বৃষ্টি জানে। মাটির মানুষের কাজ ভিজে যাওয়া কিংবা ভিজে না-যাওয়া, খরায় পোড়ার খোঁজ কারো কাছে পৌঁছে না। বাক্স জীবনের এটাই রীতি। কিশোর ক্লিনার ওগুলোর দিকে তাকিয়ে পুরো দালানের দিকে তাকায়, চোখ ঘোরায়, কাউকে দেখলে উঠে চলে যায়। নৃপেণ ধমক দিলে তার মাথা জ্বলে। একটা বিড়ি চায়। ও কয়েকটা ভাংতি টাকা ক্লিনারের পকেটে ঢুকিয়ে পশ্চাতে লাথি কষায়। আয়নায় সুমিত্রা নিজেকে দেখে। খুঁটে খুঁটে। লাল দাগগুলোতে বরফ ঘষে। তার নাভিদেশে শিরশির নিম্বন। সে আয়নাটা ভাঙতে চায়। দাগগুলোতে কুচি কুচি করে ব্লেড চালাতে চায়। তার ভাল্লাগে না। দেয়ালে টিকটিকি, বাতিটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তেলাপোকা উড়লে ঘিনঘিন করে শরীরটা। সে তার শাড়িগুলো গোনে, একটা... দুইটা... তিনটা। ব্লাউজ গোনে। ব্রেসিয়ারগুলো গোনে। টেনে নামায়, পায়ে পেষে। তার কান্না পায়। অঝর কান্নার বেগ গতিশীল হয়। কোনো দিগন্তে খুব একলা দৌড়তে ইচ্ছা করে তার। সমুদ্রের পাড়ে বসে সৈকতের সমস্ত বালি খুঁড়ে নিজেকে তার তলে লুকিয়ে নিতে চায় সে, সে চায় ভেসে যেতে গাঙচিলের ঝাঁকের সঙ্গে কিংবা কোনো সাড়সের দলে। কেচিগেটের চাবি তার কাছে নেই। সৌমেন গলা পর্যন্ত ঢালে। বার বন্ধ হয়ে যায়, তাকে পথ পর্যন্ত এগিয়ে দেয় বার-বয়েরা, সে থাকতে চায় রাতের পর রাত। নৃপেণ চাবি দিয়ে তালা খোলে। অথৈ বিচরণ করে জলধির এপার, ওপার। চুরি না, ডাকাতি না; এক অদ্ভুত চুক্তি। মাসে পঁচিশ হাজার। প্রতিবেশী বৈদ্যনাথও সুযোগ খোঁজে। সাহস করে না। অনুমান করে শুধু। দূর থেকে দেখে। কাউকে কাউকে বলে। সবাই মিলে হাসে। নৃপেণ মাস শেষে অপেক্ষা করে হাউজিংয়ের দক্ষিণ দিকে গ্যারেজ-ঘরের পেছনে। সৌমেন হ্যান্ডশেক করে মুঠোর ভিতরে চুক্তির সমপরিমাণ পরিশোধ করে প্রস্থান নেয়। পালিয়ে যাওয়ার মতো। যেতে যেতে তার চোখ যায় বড় শিরীষ গাছটার দিকে, যে গাছটাতে কখনো সে ফুল ফুটতে দেখেনি; নৃপেণই একদিন বলেছিল, ‘স্যার, গাছটা না অপুষ্পক। অসাড়ও বটে। ওই যে নপুংসক আছে না, ওইরকম।’ সৌমেন নিজের দিকে তাকায়। চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নিম্নে গড়ায়, বুক ছোঁওয়ার আগেই হাতের একটা টিস্যু তা শুষে ফ্যালে। সুমিত্রা থুতু ছিটায় নিজের দিকে। মোছে। আবার ছিটায়। সৌমেনের পুরোনো ডায়রির পাতা ওল্টায় সে। আগের লেখাগুলো পড়ে গভীর মনোযোগে। সৌমেন লিখত। নিয়মিত। গাঢ় কালিতে। তুমুল লিখত। এখন লেখে না। অনেকদিন। মোটেও না। দিন না, মাস না, বছর না। কলমটা কেবল সেলফে সাজানো। সুমিত্রা ধরে নেয় সৌমেন মদ্যপায়ী। সে ওসব জানবে না কখনো। সৌমেন জানে, সুমিত্রার জানবার কথাও না, গ্যারেজ-ঘরের পেছনে কেন মাস শেষে দেখা হয় তার আর নৃপেণের। প্রায়ই গভীর রাত করে ঘরে ফেরে সৌমেন। প্রায়ই উদাল আকাশ হয় সুমিত্রা, তার ছোট্ট নদীতে ভেসে আসে একটা টোনা মাছ। নৃপেণ। মাছে জলে সুরম্য প্রাসাদ। অবারিত ধান ক্ষেত। কেউ কাউকে আবিষ্কার করে না, তবু ডিঙিনাও ঢেউ ডিঙিয়ে যায় আদিগন্তের দিকে থৈ-থৈ থৈ-থৈ। সৌমেনের খারাপ লাগে। সুমিত্রারও। কেয়ারটেকারেরও।