ভোরে ঘুঘু পাখীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল নেহালের। এ যেন সেই ফেলে আসা কিশোর বয়সে ঘুঘু পাখির ডাক। ঘুঘু পাখির ডাকে আনন্দহীন হয়ে গেল আজকের সকালটা। মনের অজান্তে স্মৃতিপটে ভেসে উঠে শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। তাদের বাড়িটার ছিল গাছ-গাছালিতে ঘেরা। আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল-পেয়ারা সব রকমের ফলের গাছের ছিল এক সময়। বাড়িতে মস্ত বড় একটা জাম গাছ ছিল। আর ঠিক ওদের বাড়ির সামনের বাড়িটা নাহারদের। এ বাড়িতে এত গাছ-গাছালি ছিল না। ছিল মস্ত বড় একটা কড়ই গাছ। এটা নিয়ে নাহারদের বাড়ির সবাই গর্ববোধ করত। এই গাছে মগডালে বড় দুটো ঈগল পাখির বাসা ছিল। জোড়া ঈগল পাখি প্রতি বছরে দুটো ডিম দিত এবং ডিম থেকে বাচ্চা হতো। ডিম কেউ কোন দিন দেখেনি। দেখার কোনো সুযোগই ছিল না। বাচ্চাগুলো বড় হলেই ডানায় ভর করে পতপত করে কোথায় যেন চলে যেত। আর কখন ফিরে আসেনি। বুড়ো দুটো ঈগলের এটাই ছিল শেষ আশ্রয়স্থল। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তাদের পুরোনো বাসায় আঁকড়ে ধরে থাকত। ঠিক মানুষের মতো। যেমন শেষ বয়সে অসহায় হয়ে বাকি দিনগুলো কাটাতে হয়। এ বাড়ির জাম গাছ আর ও বাড়ির কড়ই গাছ। এদের না-কি আজীবন বন্ধুত্ব। তারা তাই ছিল। কি সাংঘাতিক মানুষ ছিল এই দুই বাড়ির দুই বুড়ো। একদিন বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে গেল দুটো গাছের বড় দুটো মগডাল। আর বুড়ো ঈগল দুটো কোথায় যেন চলে গেল। এ যেন নদীভাঙা মানুষের মতো। মনে হলো যেন তাদের দুটো হাত ভেঙে গেল। গাছের কষ্ট বুঝত দুই বাড়ির অবুঝ দুটো কিশোর- কিশোরী। নেহাল আর নাহার। দু’জনই সমবয়সী। ওরা দু’জন সে দিন খুব কেঁদেছিল। কাঁদতে থামতে না থামতেই দুই বাড়ির দুই বুড়ো তাদের চৌদ্দ পুরুষের সম্পদ গাছ দুটো বেচে দিল পাশের গ্রামের সত্য মিস্ত্রীর বাবার কাছে। এক দিন ভোর হতে না হতেই মিস্ত্রীর দলবল এসে গাছ দুটো কাটা শুরু করে দিলে তা দেখে নেহাল-নাহার দু’জনে না খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছিল। সারাদিন গাছ খাদকদের অমানবিক কাজ দেখতে হয়েছিল। আর মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিল। তা নিয়ে দুই বাড়ির লোকজন হাসি-তামাশা করেছিল। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে দুটো গাছের সেই ছায়া নেই, নেই পাখিদের কলতান। তাদের প্রিয় সেই জোড়া ঘুঘু পাখি আর কখনো দেখা যায়নি। এমনি করেই হয়তো একদিন ঘুঘু পাখির মতো তাদের দু’জনের দুরুত্ব বেড়ে যাব। দুই বাড়ির বয়স্কদের মধ্যে কোনো সদ্ভাব ছিল না। যে টুকু ছিল মহিলাদের সঙ্গে। কিন্তু দুই কিশোর-কিশোরী ভাব ছিল গভীর। সেই গাছ-গাছালিও নেই আর এই দুই কিশোর-কিশোরীর মধ্যে দূরত্ব বেড়েই গিয়েছিল।
কতকাল দেখা-সাক্ষাৎ নেই। এক মুহূর্তে যাদের দেখা না হলে দিন কাটত না। জাম-কড়ই গাছে বাস করত কত রকমের ছোটবড় পাখি। ভোর না হতেই কিচিরমিচির শব্দে আহারের খোঁজে বাসা ছেড়ে চলে যেত আবার সন্ধ্যা নামতেই তাদের চিরচেনা বাসায় ফিরে আসত। দু’জন খুব আনন্দ পেত। তাদের সব চেয়ে প্রিয় ছিল ঘুঘু পাখি। গাছের ডালে পাতার ফাঁকে জোড়া ঘুঘু ভোর বেলায় ডেকে উঠত আর ওদের ঘুম ভেঙে যেত। দু’জন সারাদিন দুটো ঘুঘু পাখিকে চোখে চোখে রাখত। বাড়ির একটু দূরেই ছিল বোসদের বাগান বাড়ি। তাতে হরেক রকম পাখি বাস করত। শুধু পাখী নয়, শিয়াল, বেজি এমনকি সাপও ছিল। নেহাল-নাহারের একমাত্র আর্কষণ ছিল ঘুঘু পাখির দিকে। এক জোড়া ঘুঘু পাখি আর এক জোড়া কিশোর-কিশোরী এরা যেন একে অপরের আত্মা। স্কুলে একসঙ্গে, খেলাধুলা একসঙ্গে, শুধু গোসল-খাবার আলাদা। দিনে দিনে সময় চলেছে নিজের গতিতে। নেহালের প্রাইমারি পড়া শেষ করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। থাকে নানার বাড়িতে। নাহারের পড়ালেখা এখানেই শেষ। আশপাশে কোনো হাই স্কুল নেই। প্রায় তিন-চার মাইল দূরে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নাহারের বাবা তাকে কোথাও ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়নি। আসলে মেয়ে বলে সম্ভব ছিল না। দু’জন এখন কিশোর- কিশোরী হতে বালক-বালিকায় পরিণত হয়েছে। নাহার ফ্রক-সালোয়ার ছেড়ে মেয়েদের ছোট শাড়ি পরিধান করতে শুরু করেছে। ছুটিতে নেহাল বাড়ি এলে আগের মতো নাহারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা সম্ভব ছিল না। তবুও তাদের চুপিসারে দেখা হতো। ততদিন তাদের ঘুঘু পাখির ডাক কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
নেহাল পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আর নাহার তার মায়ের সঙ্গে ঘর-সংসারের কাজে সাহায্য করে সময় কাটিয়ে দেয়। দেখা-সাক্ষাৎ খুবই কম হতো। নেহালের অপেক্ষায় থাকত নাহার। পাশাপাশি বাড়ি তাদের। সুযোগ পেলেই নাহার নেহালদের বাড়িতে গিয়ে নেহালের মাকে বলতে, চাচি, তোমাদের নেহাল কবে বাড়িতে আসবে। নেহালের মা নাহারের মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিত, দেখতে ইচ্ছে করছে, তাই নারে। বয়েই গেছে। কবে আসবে তাই জানতে চেয়েছি। নেহালের মা মুচকি হেসে বলত, এই তো সামনের মাসে ছুটি হবে, তখন বাড়িতে আসবে। নাহার আঙুলের কড় গুনে হিসাব করে বলত আর মাত্র সাত দিন বাকি আছে। খুশি হয়ে এক দৌড়ে চলে যেত। নেহালের মা তাকিয়ে মৃদু হেসে বলত, পাগলি মেয়ে।
ছুটিতে বাড়ি এলে নাহারের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা হতো। তাদের কথাবার্তা ছিল খুবই সীমিত। কোনো আবেগের কথা নয়, কোনো অভিমানের কথা নয়। প্রেম বলে কোনো অনুভূতি তাদের মনে স্থান পায়নি। কি যে কথাবার্তা হতো তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। এখন আর ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যায় নারে নেহাল। জানিস, আমার নানার বাড়িতে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাই না। তাই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন তোর কথা মনে পড়ে যায়। আমারও তাই। এই ছিল দুই বালক-বালিকার মনের ভাব প্রদান। ঘড়ির কাঁটা চলে তার নিজ গতিতে। নেহাল আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততায় সময় কাটায়। বাড়িতে আগের মতো আসা হয় না। দু’জনের বয়স এখন পনের-ষোল বছর। গ্রামে এই বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। নাহারের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে। নেহালের কথা মনে হলেই মনটা উদাস হয়ে যেত। রাতে শুয়ে নেহালের কথা ভেবে চুপিচুপি কতবার কেঁদেছে। নেহাল বাড়িতে এলেও আগের মতো দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। বাড়ির বড়রা চোখে চোখে রাখত নাহারকে। তাই কাছে আসা হতো না। নেহাল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত নাহার আগের মতো নেই। পরিবর্তন তার শরীর। পরিপূর্ণ যুবতী। ভরা যৌবন। ইচ্ছে করলেও তাকে নিয়ে আগের মতো একসঙ্গে বেড়ানোর সুযোগ ছিল না। দূরত্ব বেড়ে গেছে তাদের মধ্যে। কিন্তু কেন যেন মনের ভেতরে অনুভূতি জাগে। দেখার ইচ্ছে জাগে। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে দু’জনের দেখা হয়েছিল। কত সময় চোখে চোখে তাকিয়েছিল কেউ বুঝতে পারেনি। ওমন করে কী দেখছ নেহাল। তোকে, তুই দেখতে এত সুন্দর। তোর চোখ দুটো ডাগর ডাগর আর হাসিটা খুব মিষ্টি। আগে দেখনি। এ ভাবে কখনো দেখিনি। আর দেখে লাভ নেই। তুমি তো এখনো বালক। আর আমার হবু বর শুনেছি চাকরি করে। আমার চেয়ে তের-চৌদ্দ বছর বয়সে বড়। তাই নাকি। আমাদের কি আর কখনো দেখা হবে না। হয়তো এটাই শেষ।
আজ কেন মনে হচ্ছে দু’জন দু’জনকে কিছু সময়ের জন্য জড়িয়ে ধরি। কিন্তু তা কি সম্ভব। অনেক আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নেহাল, চল এখন বাড়ি যাই। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে। মাঝে মাঝে ঘুঘু পাখির ডাক শুনলেও তাদের আর এ জীবনে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।