গল্প

বিপরীত পিঠের গল্প

পিওনা আফরোজ

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শোন জামাল, হঠাৎ করেই একটা জরুরি কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরব, তখনই শরীরটা খুব খারাপ লাগল। হাসপাতালে এলাম। ওরা আমাকে ভর্তি করে নিল। তুই দ্রুত চলে আয়। কথাগুলো বেশ দুর্বল স্বরে ভাতিজা জামালকে ফোনে বললেন মাসউদ আহমেদ।

চাচা। আমি এখনই আসতেছি। আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না।

গ্রীষ্মের দুপুর। বাইরে খর রৌদ্র। কথা শেষ করেই জামাল চাচার ঘরে যায়। কী করবে এখন সে? চাচার কাছে যাবে? নাকি এই সুযোগটা কাজে লাগাবে। সে তো বহুদিন অপেক্ষা করেছে, চাচা তার দিকটা ভাবেনই নাই। আজ সুযোগটা যদি কাজে না লাগায়, তাহলে এতদিনের স্বপ্ন, সব পরিকল্পনা গুঁড়িয়ে যাবে!

ভাবনায় পড়ে জামাল- চাচার ঘরে যাবে, না হাসপাতালে।

চাচার ঘরে ঢোকে জামাল। এর আগে চাচার ঘরে যখনই সে এসেছে তখনই তার বুকটা ধক্ করে উঠত। আর এখন খালি ঘরে তার হৃৎপি-টা বেধড়ক লাফাতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে হৃৎপি-টা লাফাতে লাফাতে শরীর থেকে বেরিয়ে পড়বে। তার পরপরই আশপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কিনা! না, বাড়িতে কেউ নেই।

সে এক এক করে সব জায়গায় আলমারির চাবিটা খুঁজতে থাকে। আলমারিতেই চাচার নগদ টাকা আর গয়নাগুলো আছে।

জামালের চাচির ছিল অনেক গয়না। জামাল জানে। চাচির মৃত্যুর পর গয়নাগুলো তার চাচা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। তার চাচা চাচিকে ভালোবেসে একবার একটা চেইন উপহার দিয়েছিলেন, ওজনে বেশ ভারী। তাতে তার চাচির নাম খোদাই করা ছিল। ওই গয়নাটা তার চাচা প্রায় সময়ই নেড়েচেড়ে দেখেন- সে দেখেছে।

কিন্তু জামালের চাচা মাসউদ আহমেদ বরাবরই খুব সচেতন মানুষ। স্ত্রী মারা যাবার পর শোকে বিহ্বল হলেও ঠিকঠাক সবকিছু সামলে নিয়েছেন। জীবনের দুঃসময় তাকে ক্লান্ত করলেও পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। ঘরের সবকিছু স্ত্রীর অবর্তমানে তিনিই নিজের হাতে যত্ন করে গুছিয়ে রাখেন। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন বলেই তার সব স্মৃতিগুলো সজ্ঞানে পরম যত্নে আর ভালোবাসায় আগলে রাখেন। তিনি থাকাকালীন কখনোই তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে কিছু সরানো সম্ভব হয়নি জামালের।

শুধু চাচার সম্পদের উত্তরাধিকার হওয়ার জন্য জামাল দিনের পর দিন বয়স্ক, একাকী, নিঃসন্তান মাসউদ আহমেদকে সময় দিয়েছে। বহু রাত গভীর হয়েছে তার, বৃদ্ধ মাসউদ আহমেদের ব্যথিত হৃদয়ের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের গল্প শুনে শুনে। মাসউদ আহমেদ যখন যেখানে যেতেন সঙ্গে জামালও সেখানে যেত। এমনকি মসজিদেও, একা ছাড়ত না কখনও। এই কাজগুলো যে জামালের জন্য খুব সুখকর বা আনন্দদায়ক ছিল, তা মোটেও নয়। উদ্দেশ্য ছিল, কৌশলে যদি তার কাছ থেকে কিছু সম্পদ বা টাকা-পয়সা আদায় করা যায়! এছাড়া ছোটবেলা থেকেই চাচার সব সম্পত্তির দেখাশোনা চাচির সঙ্গে জামাল নিজেও করত। ধানের কাজ, পুকুরে মাছের চাষ, গরুর খামার, বাগানের পরিচর্যাসহ সংসারের প্রয়োজনীয় সব কাজই সে করত। চাচা থাকতেন তার চাকরি নিয়ে। এতগুলো বছর পর এখন জামালের মনে হয়, সে শুধু এ সংসারে দিয়েই গেল অথচ তার দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে ভাববার মতো সময় চাচার কখনো হয়নি।

তাই আজ সুযোগ পাওয়ায় সে ভাবে, সারা জীবন এই পরিবারের পেছনে সে যে সময় এবং শ্রম দিয়েছে তার সবটুকু সুদে-আসলে ফেরত নেবে। এই ভাবনা থেকেই জামাল ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে দেখল, কোথাও আলমারির চাবিটা পাওয়া যায় কি-না! চাবিটা তার খুব দরকার। শুধু চাবিটা পেলেই খুলে যাবে তার সৌভাগ্যের দরজা। আজকের পর আর কখনও তাকে টাকার জন্য কষ্ট করতে হবে না। এবার তার এতদিনের স্বপ্ন, পরিকল্পনা, স্বার্থক হতে যাচ্ছে।

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার, তোশকের নিচে, বালিশের নিচে, এমনকি ঘরের প্রতিটি কোণেও খুঁজে দেখছে। আর ভাবছে, এই বুঝি পেয়ে গেল! এই বুঝি সবটাই তার হলো! তারপরই ওকে আর পায় কে? কিন্তু না, কোথাও সে চাবি খুঁজে পায়নি। এমনকি কোনো টাকা বা গয়না কিছুই পাওয়া যায়নি। তাহলে? চাবি কি চাচা সঙ্গে নিয়ে গেছেন? আবার ওর খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছে এই ভেবে যে, কখন আবার চাচা বাড়ি চলে আসেন।

এরকম নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে তার চোখ পড়ে খাটের নিচে একপাশে রাখা এক জোড়া জুতোর দিকে। সেই জুতোর ভিতরে দুটো মোজাও রয়েছে। মোজাজোড়া বের করতে গিয়ে দেখে, তার ভিতর থেকে চিকচিক করছে অনেকগুলো সোনার গয়না। এত গয়না দেখে সে আনন্দে উদ্বেলিত। এমন কতগুলো গয়না আছে তা দেখার জন্য তার মন ছটফট করছে। সে তাড়াহুড়ো করে মোজার ভেতর থেকে হাত দিয়ে টেনে গয়নাগুলো বের করে বিছানার ওপর ছড়িয়ে রাখে।

জামালকে ফোন করার পর অনেকটা সময় কেটে গেলেও জামাল হাসপাতালে না পৌঁছালে মাসউদ আহমেদ চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবেন, ছেলেটার কোনো বিপদ ঘটল না তো! কোনো অ্যাকসিডেন্ট-ট্যাকসিডেন্ট! ফোনটাও তো বন্ধ। কী করবেন তিনি বুঝতে পারেন না। গভীর এক নিস্তব্ধতায় ঢেকে থাকে মাসউদ আহমেদের ছোট্ট কেবিনটা। গভীর আচ্ছন্নতার আড়ালে বিছানায় শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন মাসউদ আহমেদ, জামালের আসার প্রতীক্ষায়।

সময় গড়াতে গড়াতে মাসউদ আহমেদের শরীরটা আগের চেয়ে খারাপ হতে থাকে। ক্লান্তিতে চোখ দুটো বারবার বন্ধ হয়ে যেতে চায়। প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় মুখটাও বিকৃত হয়ে গেছে।

এক সময় হাসপাতালে পৌঁছায় জামাল। তাকে দেখেই কর্তব্যরত ডাক্তার দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, সরি, অনেক দেরি হয়ে গেছে। জামালের হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ তুলে দিয়ে বলেন, মাসউদ আহমেদ এটা আপনাকে দিতে বলেছিলেন। যাতে রাখা ছিল মাসউদ আহমেদের ঘড়ি, চশমা, একটা চাবির গোছা আর একটি চিঠি-

জামাল,

জীবদ্দশায় তোর জন্য কিছু করা হয়নি, করাটা উচিত ছিল আমার। আমার নিঃসঙ্গতার তুই-ই তো ছিলি একমাত্র আশ্রয়। আমার যা আছে সবকিছু তোর নামে উইল করা আছে। আলমারি খুঁজলে পেয়ে যাবি।

আর তোর চাচিকে দেওয়া গলার চেইনটা দোয়া স্বরূপ তোর মেয়ে বন্যাকে দিস।

চিঠিটা পড়ে তীব্র অনুশোচনায় জামালোর দু’চোখ তপ্ত হয়ে ওঠে। অসীম এক শূন্যতা তাকে যেন উপহাস করে।