ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাউণ্ডুলে ও একটি জ্যোৎস্না রাত

জোবায়ের মিলন
বাউণ্ডুলে ও একটি জ্যোৎস্না রাত

আমাকে তখন বাসা থেকে এক প্রকার বের করে দেয়া হয়েছে। প্রথমে ছোট মামার বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম। রাত দেড়টা। পরদিন মামির জেরার মুখে ওই দিনই তাদের বাসা থেকে চলে আসতে হয়েছিল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। অনিচ্ছা এই কারণে যে, এই জনজঙ্গলের শহরে আমার আর থাকার বা নিজ বাড়ি ছেড়ে গিয়ে ওঠার দ্বিতীয় কোনো আশ্রয়স্থল ছিল না। তবু আমি এক বন্ধুর বোনের বাড়িতে দিন শেষে উঠেছিলাম কোনো উপায়-অন্তর না পেয়ে। কেননা, আমি আর সেই বাড়িতে ফিরতে চাই না, যে বাড়িতে আমার মায়ের স্থান হয় না।

মা-সহ আমাকে আমার বন্ধুর বোন অনেকটা আপনের মতো জায়গা দিয়েছিল এবং অনেক দিন পর্যন্ত কোনো খরচপাতি ছাড়াই দায়িত্ব পালন করেছিল। অবশ্য তার পেছনে বিরাট কোনো কারণ না থাকলেও একসময়ে বন্ধুর এই বোনটির কোনো উপকারী যে আমি লাগিনি এমন নয়। তার নাম ইরা। বড় নাম ইরা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় প্রথম বর্ষের এক হারামির সঙ্গে তার প্রেম হলো। গাঢ় প্রেমই বলা চলে। কিন্তু ছেলেটার গতি ভালো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও রাজনীতি, মদ, নারী ইত্যাদি নিয়ে তার কোনো বিকার ছিল না। যখন যা ইচ্ছা হতো তখন তাই করত। আমরা যারা তার সিনিয়র ছিলাম, আমাদেরও পাত্তা দিত না মোটেই। তবে ইরার জন্য পাগল ছিল। উঠতে বললে উঠত, বসতে বললে বসত, আড়ালে গেলে সে তার মতোই ভূগোলহীন এক জীবন যাপন করত। কেউ উপদেশ দিতে গেলে শুনত ঠিকই, পাশ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গালি দিতে দেরি করত না। বন্ধুর অনুরোধে ইরাকে তখন অনেকে বুঝাত। আমিও। কী এক দৈব কারণে ইরা যেমন আমাকে মান্য করত, ওই হারামিটাও করত। মান্য করলে কার না ভালো লাগে। সবাই তাদের দু’জনের মিল মানতে না পারলেও আমি কেন যেন চাইতাম তাদের মিল হোক। ইরা একবার সবার বিদ্রোহে নিজেই বিদ্রোহ করে বসল ডেটল খেয়ে। পরিবারের কেউ তেমন একটা তার পাশে দাঁড়াল না। আমি আমার বন্ধুর বন্ধুতা এড়িয়েই ইরার জন্য দিন-রাত এক করেছিলাম যে, একটা ঘাসফড়িংয়ের মতো মেয়ে কী করে মরে যাবে ভালোবাসার কথিত অপরাধে!

ইকরাম আমার ছোট বেলার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে স্কুলে, কলেজে পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চান্স হলো না, আমার হলো। কষ্টে বলেছিলাম, আমি ভর্তি হবো না। ইকরাম সে বেলায় শান্ত করেছিল আমাকে। আমি ভর্তি হলাম রসায়নে আর ইকরাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থে। কয়েক বছর পর ইকরাম স্টুডেন্ট ভিসায় সাউথ কোরিয়ায়। আমি নিজে ঢাকায়। এখনও ইকরাম সেখানেই। বড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কোটিপতি। আমাদের দেখা হয় না অনেক বছর। মন পোড়ে। টের পাই। সেও টের পায়। ভার্চুয়াল এই সময়ে সপ্তাহে স্বল্প দেখা হয় ইমোতে, ভাইভারে। তার কাঁধে বিশাল ব্যস্ততা। আমার কাঁধে নির্ভেজাল শান্তি। পরবর্তী সময়ে ইরার বিয়ে হয়েছে ওই ছেলেটার সঙ্গে। তার হারামিপনা কমেছে। বদখত দিতে যায় না। যাকে বলে পরিপাটি শুদ্ধ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে একটা উচ্চমানের দেশি কোম্পানিতে চাকরি করছে। সততার করণে মোটা সেলারি পায়। পরিশ্রমী বলে উপার্জনও ভালো। পয়সা নষ্ট করে না কোথাও, যা তার ব্যয় ইরার জন্য। ইরার হাতেও উন্নত অর্থ আয়ের সুযোগ এসেছিল। সে গ্রহণ করেনি। স্বামীর বিশ্বস্ত প্রেমের কারণে। একজন বাইরে আয়-রোজগার করছে। আরেকজন গৃহ গোছাচ্ছে। ইরা অবশ্য বলে, ‘গৃহ গোছানোও একটা চাকরি। এখানেও শিল্প আছে। শিল্পীকে যদি মূল্যায়ন করা হয় যে কোনো ক্ষেত্রই শিল্প হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে শিল্পী।’ চাকরি করতে তার স্বামী নিষেধ বা বারণ করেছে এমন নয়, তারা দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজটাকে ভাগ করে নিয়েছে তাদের কীসে শান্তি সেদিক বিবেচনা করে।

আমার কাঁধে নির্ভেজাল শান্তি একই কারণে যে, আমার গৃহ-সংসারের ঝামেলা নেই। একা মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর থেকেই আমি কয়েকটি স্বেচ্ছাশ্রম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। কল্যাণের ডাকে, হিতৈষী কর্মে আমার সময় চলে যায়। কাউকে কাউকে আমি দিনে চার ঘণ্টা, কাউকে তিন ঘণ্টা, কাউকে কোনোদিন আট ঘণ্টা সময় দিই। তাদের কাছ থেকে হাত খরচের সম্মানী যা আসে তা দিয়ে আমার চলে যায়। এ নিয়ে যদিও পরিবারের কোনো সদস্যেরই মনে শান্তি নেই। দুশ্চিন্তার অন্তও নেই। বারবার বলেছি, চিন্তা করো না। কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্যনের চেয়ে মনের শান্তি অর্জন করাটা কম নয় একজন মানুষের জীবনে। তারা আমার কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। দেবে বলেও মনে হয় না। তাই তো বাসা থেকে বের করে দিয়েছে বা আমি বের হয়ে এসেছি- একটা কিছু হবে।

ইরার বাসায় সময় খারাপ কাটছিল না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত