প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথের ঘর-সংসার

শরিফুল ইসলাম

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অনেকের ধারণা, জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত জমিদার বাড়ির সন্তান রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন বেশ সুখেই কেটেছে। লোক-লস্কর পরিবেষ্টিত সচ্ছল জীবন। এমন জীবনই তো কাব্যকলা, নাট্যকলার উপযুক্ত ক্ষেত্র। ভোগবিলাসী রাজা বা জমিদাররা জলসাঘরে, কিংবা শিকার করে সময় কাটাতেন আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ না হয় লেখালেখি করে সময় কাটিয়েছেন। ভাত-কাপড়ের কষ্ট তো আর করতে হয়নি। অনেকে রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারি জীবন পেলে ওরকম অনেক সাহিত্য রচনা করতে পারতেন বলেও আফসোস করে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উপরিউক্ত ধারণা মোটেও সমীচীন নয়। বরং নানা দুঃখকষ্টের সঙ্গে সংগ্রাম করার পরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যেমন দুখুমিয়া বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনটাকে পর্যালোচনা করলেও অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথকে ‘দুখু ঠাকুর’ বলা মোটেও অযৌক্তিক হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা, আমাদের রাষ্ট্রভাষার একমাত্র নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথের জীবনীটুকুও আমারা অনেকে জানি না, জানার আগ্রহও অনেকের নেই। কবির বংশধরদের কেউ এখনো বেঁচে আছে কি না- এ প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর অনেকে দিতে পারেন না। ৪৭-এর দেশভাগের পরে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যেমন রবীন্দ্রনাথকে বয়কটের জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিল ঠিক তেমনি কিছু ধর্মান্ধ বাঙালিও সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম ও রবীন্দ্র দর্শনকে এড়িয়ে চলেছে। আজো যে বাংলাদেশে রবীন্দ্রবিরোধী চেতনার মানুষ নেই তা কিন্তু নয়। সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার একমাত্র দাবিদার বাংলাদেশের মানুষ। আর সে কারণে রবীন্দ্রনাথ এখন ভারতের চেয়েও বেশি পরিমাণ বাংলাদেশের। নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথের কর্ম ও দর্শন, তার ব্যক্তিজীবনের সংগ্রামের কথা তাই খুব বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। সংসার জীবনে কাজী নজরুল ইসলামের মতো অর্থনৈতিক টানাপোড়েন রবীন্দ্রনাথের না থাকলেও স্বজন হারানোর বেদনা তার কষ্টের অন্যতম কারণ। মাতা, বৌদিদি, স্ত্রী এমনকি প্রাণাধিক সন্তানের মৃত্যু অত্যন্ত কাছে থেকে দেখে দেখে রবীন্দ্রনাথ যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা তার অনেক রচনার অনুষঙ্গ হয়েছে। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সংসার জীবন সম্বন্ধে জানার আগ্রহ তাই যে কোনো রবীন্দ্র ভক্তের চিরন্তন ভাবনা। সে ভাবনা থেকেই এ নিবন্ধের সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথের মাতা সারদা দেবী পনেরটি সন্তানের গর্বিত জননী। রবীন্দ্রনাথ চৌদ্দতম। তার পরের ভাইটি অর্থাৎ পনেরতম ভাইটির নাম ছিল বুধেন্দ্রনাথ। মাত্র দেড়বছর আয়ু পেয়েছিলেন বুধেন্দ্রনাথ। আর সে কারণে রবীন্দ্রনাথই যে তার জীবিত ভাইবোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সে কথা বোধকরি বলা চলে। কনিষ্ঠ সন্তান হলেও রবীন্দ্রনাথ মায়ের যত্ন আদর কিছুই তেমন পাননি। কবি নিজেই তার মায়ের সান্নিধ্য ও স্নেহমমতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘মাকে জানিনি, তাকে পাইনি কখনো। তিনি থাকতেন তার ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাত গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতো- যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস জানতুম কই আর!’ কবির মাতা সারদা দেবী অসুস্থ থাকতেন প্রায়ই। তাই রবীন্দ্রনাথকে দেখাশুনা, গোছল করানো ও খাওয়াদাওয়া সবই করাত চাকর-বাকররা। কখনো তার বড় দিদিরাও দেখাশুনা করতেন। ১৮৭৫ সালের ৮ই মার্চ রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ১৩ বছর ১০ মাস তখন তার মাতা সারদা দেবী রবিকে সুবিশাল বিশ্বসংসার গগনে একা রেখে পরলোকে পাড়ি জমালেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আধ্যাত্মিক জগতে নিজেকে আরো নিবিঢ়ভাবে সমর্পণ করেছিলেন। ঠাকুর বাড়ির জনকোলাহল থেকে মহর্ষি দূরে থাকতেন স্বতন্ত্র বাসস্থানে। মাতৃহীন রবীন্দ্রনাথ তাই পিতার স্নেহও ঠিকমতো পাননি। মায়ের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ চাকর-বাকর আর বৌদিদিদের ছায়ায় বড় হতে লাগলেন। বৌদিদিদের মধ্যে তার সেজবৌদিদি কাদম্বরী দেবী মাতৃহীন এই দেবরটিকে অন্যান্য বৌদিদিদের চেয়ে কিছুটা বেশি ভালো বাসতেন। নাওয়া খাওয়া ছাড়াও কাদম্বরী দেবী শিশু রবীন্দ্রনাথের মানস গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বাল্য বয়সের কাঁচা হাতের সাহিত্যকর্মের প্রথম পাঠক হতেন কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের রচনার কঠোর সমালোচকও ছিলেন। রচনার ভালোমন্দ বিশ্লেষণ করতেন কবির সঙ্গে। ভালো রচনার জন্য সেজবৌদিদির প্রশংসাও পেতেন কবি। একজন মাতৃহীন কিশোরের এতটা কাছের মানুষের আত্মহত্যা তাই বোধহয় কবিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার (১৯ এপ্রিল ১৮৮৪) পরে রবীন্দ্রনাথ মায়ের মৃত্যুর মতোই গভীর শোক পেয়েছিলেন। বউদিদি কাদম্বরীর দেবীর মৃত্যুর পরে তার নাওয়া খাওয়ার নিয়ম রইল না। রাতে ঘরের ছাদে বসে দূর আকাশের নক্ষত্রের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন। বউদিকে স্মরণ করেই একদিন লিখলেন- ওই যে সুদূর নীহারিকা/যারা করে আছে ভীড় আকাশের নীড়/তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?/তুমি কেবলি ছবি- শুধু পটে লেখা? শিল্প-সংস্কৃতি, আর শিক্ষা-দীক্ষায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সুনাম তখন ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েও পৌঁছেছে। সেই বাড়িতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো মহৎপ্রাণ মানুষের স্ত্রী হয়ে যিনি এলেন তার শিক্ষাদীক্ষা তেমন ছিল না বললেই চলে। তবে ঠাকুর বাড়িতে আসার পরে তিনি শিক্ষাদীক্ষা ও সংগীত সাধনায় অনেকখানি অগ্রসর হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর দাম্পত্য জীবন মাত্র ১৯ বছরের। আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী কবিকে আগলে রেখেছিলেন ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে। ৫টি সন্তানের জননী কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর কবিকে একা রেখে তিনি মরণ সাগরের ওপারে চলে গেলেন। একে একে মা সারদা দেবী, সবচেয়ে প্রিয় বৌদিদি কাদম্বরী দেবী এবং জীবন সঙ্গিনী মৃণালিনী দেবীর অকাল প্রয়াণই বোধহয় কবির মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচনার অনুষঙ্গ সৃষ্টি করেছিল। রবীন্দ্রনাথের সন্তানদের সম্পর্কে বর্তমান ব্যস্ত বাঙালিদের কৌতূহল আছে কিন্তু সেসব জানার জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়ন দরকার আর এজন্য যে সময় ব্যয় করা দরকার তা অনেকের নেই। সহজ কথায় স্বল্প সময়ে রবীন্দ্রনাথকে জানা যায় না। তবু স্বল্প পরিসরে পাঠকদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের কিছু কথা আলোচ্য নিবন্ধে তুলে ধরা হলো। রবীন্দ্রনাথ মাতা, বৌদি এবং স্ত্রীর অকাল প্রয়াণেই শুধু ক্ষত-বিক্ষত হননি বরং তার সন্তানদের অকাল প্রয়াণও কবিকে আঘাতের পর আঘাত আর কষ্টের পর কষ্ট দিয়ে গেছে। সাহিত্য চর্চার গভীর সাগরে অবগাহন করে কবি সেসব কষ্ট ভুলতে চেয়েছেন। তবে কর্তব্যকর্মে কখনো কবির বিন্দুমাত্র অবহেলা ছিল না। স্ত্রী কিংবা সন্তানদের চিকিৎসা এবং জমিদারি পরিচালনায় ঘোরতর সংসারী মানুষও রবীন্দ্রনাথের মতো অতটা কর্তব্যসচেতন থাকেন না অনেক সময়। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কবি আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি। ১৯০২ সালের পরে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ৩৯ বছর কবি সন্তানদের নিয়ে একা সংসার সামলেছেন। কবির স্ত্রী নোবেল প্রাইজ পাবার সুসংবাদটিও জেনে যেতে পারেননি। সন্তানদের কারণেও কবিকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। সন্তানদের সুখী করার জন্য তিনি যথাশক্তি চেষ্টা করেছেন। এবার জানা যাক তার সন্তানদের পরিচয় ও শেষ পরিণতি। ১. রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান: কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সন্তানটি ছিল মেয়ে। কবি প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন মাধুরীলতা। ডাকনাম বেলা। বেলার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৬ সালে। অসাধারণ রূপ-যৌবনের অধিকারিণী ছিলেন বেলা। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর চতুর্থপুত্র শরৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে বেলার বিয়ে হয় ১৯০১ সালে। বিয়ের সময় কবি তার বড় জামাতা শরৎ চক্রবর্তীকে সেসময় দশ হাজার টাকা নগদ যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জামাইকে কবি তার নিজ খরচে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়িয়ে আনিয়েছিলেন। ব্যারিস্টারি পাস করে শরৎ চক্রবর্তী কলকাতা ফিরে এসে শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে থেকেই হাইকোর্টে প্রাকটিস করতেন। কিন্তু পারিবারিক কোনো এক অপ্রীতিকর বিষয়ের কারণে শরৎ তার স্ত্রী বেলাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শরৎ তার শ্বশুর রবীন্দ্রনাথকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। সে চাইত না তার শ্বশুর তার বাড়িতে আসুক। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারার পরে গোপনে তিনি তার বড় মেয়ে বেলাকে দেখে আসতেন। শরৎ যখন কোর্টে চলে যেত তখন রবীন্দ্রনাথ বেলাকে দেখতে যেত। কোনো কোনো দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বড়জামাই শরতের দেখা হয়ে গেলে শরৎ ইচ্ছা করেই শ্বশুরকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করত। অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের সামনেই সিগারেট ধরিয়ে জুতাশুদ্ধ পা টেবিলের উপর তুলে শরৎ কথা বলত। রবীন্দ্রনাথ মেয়ের সুখের কথা ভেবে সবকিছু নীরবে হজম করতেন। বেলা তার স্বামীর এ ধরনের আচরণ পছন্দ না করলেও তার বোধহয় স্বামীকে শোধরানোর ক্ষমতাও ছিল না। শ্বশুর বাড়িতে বেলাকে অনেক কষ্ট নিয়েই থাকতে হতো। বেলা শ্বশুর বাড়ি নানা কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শ্বশুর বাড়িতেই শেষপর্যন্ত সে মারা যায়। বেলার জীবনের ছায়া লক্ষ্য করা যায় কবির ‘হৈমন্তী গল্পে। ২. রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান: রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তানটি ছেলে। পিতার নামের সঙ্গে মিল রেখেই তার নাম রাথা হয় রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৮ সালে। রথীন্দ্রনাথ পিতার নির্বিঘ্ন সাহিত্যচর্চায় নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। রথীন্দ্রনাথ তার পিতার শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে কৃষিবিজ্ঞান শাস্ত্র অধ্যয়ন শেষে লব্ধ জ্ঞান শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে প্রয়োগের চেষ্টা করেন। রথীন্দ্রনাথের মাতা মৃণালিনী দেবী কলকাতায় ঠাকুর বাড়ির পাশে প্রতিবেশী এক ভদ্রলোকের প্রতিমা নামের একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করতেন। মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছা ছিল প্রতিমার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেবার। রবীন্দ্রনাথের কানেও বিষয়টি গিয়েছিল। কিন্তু মৃণালিনী দেবীর অকাল মৃত্যু এবং রথীন্দ্রনাথের আমেরিকায় পড়তে যাবার কারণে সে ইচ্ছাটি আর বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়নি। এরইমধ্যে প্রতিমার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিমা বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। রবীন্দ্রনাথ অবশেষে স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। কবি রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিধবা প্রতিমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমা দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। তবে তারা নন্দিনী (পুপে) নামের একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন পরিচালনা করতেন। ১৯২১ সাল থেকেই রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের প্রধান কর্মসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরে রথীন্দ্রনাথের কাঁধে শান্তিনিকেতন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে ভারত সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংস্কার আনে তাতে পিতার সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে রথীন্দ্রনাথকে উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তবে দায়িত্ব ও পদ অনেক বড় হলেও শান্তিনিকেতন পরিচালনার ক্ষেত্রে রথীন্দ্রনাথের আর আগের মতো স্বাধীনতা থাকল না। সরকারের নির্দেশ ও শান্তিনিকেতন পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া রথীন্দ্রনাথের একার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রইল না। বাবা ও নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে কেবল একজন বেতনভুক কর্মচারীর মতো কাজ করতে রথীন্দ্রনাথেরও মন চাইল না। তাই তিনি ১৯৫৩ সালে উপাচার্যের পদে ইস্তফা দিলেন এবং দেরাদুনে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৬১ সালে পিতা রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। এই শতবর্ষ অনুষ্ঠান উদযাপনের একমাস পরেই ১৯৬১ সালের জুন মাসে রথীন্দ্রনাথ পরলোকগমন করেন।

৩. রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় সন্তান মেয়ে। কবি নাম রেখেছিলেন রেনুকা দেবী। ডাক নাম রানী। ১৮৯১ সালে রানীর জন্ম হয়। রানী ছিল প্রচণ্ড জেদী। শত বকলে বা মারলেও সে কাঁদত না। রবীন্দ্রনাথ বড় মেয়ে বেলার বিয়ের দেড় মাস পরে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামক জনৈক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে রানীর বিয়ে দেন। কবি বড় জামাইয়ের মতো মেঝজামাইকেও নিজ খরচে ডাক্তারি পড়ার জন্য লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন। ১৯০২ সালে কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর নয় মাস পরে তার দ্বিতীয় কন্যা রানীও যক্ষ্মায় মারা যায়। কবি রানীর চিকিৎসার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। বায়ু পরিবর্তনের জন্য রানীকে নিয়ে কবি হিমালয় অঞ্চলে দুর্গম পাহাড়েও সকন্যা অবস্থান করেছেন।

৪. রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ সন্তান মেয়ে। নাম অতসী দেবী। ডাকনাম মীরা। ১৮৯২ সালে অতসী দেবীর জন্ম হয়। মাতৃহীনা মীরার যখন ১৩ বছর বয়স তখন নগেন্দ্রনাথ নামক একজন ব্রাহ্মযুবক রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে অনুরোধ জানায় যে, তাকে আমেরিকায় যাবার ব্যবস্থা করে দিলে সে মীরাকে বিবাহ করতে রাজী আছে। দেখতে সুপুরুষ-শিক্ষিত-মুক্ত মনের ব্রাহ্মযুবক নগেন্দ্রনাথকে কবির পছন্দ হলো। মীরার সঙ্গে কবি নগেন্দ্রনাথের বিবাহ দিলেন। কবির খরচে নগেন্দ্রনাথ আমেরিকা গিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে ফিরে এলেন। মীরার গর্ভে দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। একটি ছেলে নাম নীতিন্দ্রনাথ অপরটি মেয়ে নাম নন্দিতা। তবে নগেন্দ্রনাথ ও মীরার দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নন্দিতার জন্মের পরে নগেন্দ্রনাথ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তাদের পরিত্যাগ করে চলে যায়। মীরা ও সন্তানরা এরপর কবির কাছেই থাকতে লাগল। ১৯৩২ সালে মীরার ছেলে নীতিন্দ্রনাথ মাত্র ২০ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মীরার মেয়ে নন্দিতার বিয়ে হয় উত্তর ভারতের এক অবাঙালি যুবকের সঙ্গে। নন্দিতা নিঃসন্তান ছিলেন।

৫. রবীন্দ্রনাথের পঞ্চম সন্তান: রবীন্দ্রনাথের পঞ্চম অর্থাৎ শেষ সন্তানটি ছিল ছেলে। কবি তার নাম রেখেছিলেন শমীন্দ্রনাথ। শমীন্দ্রনাথের চেহারায় রবীন্দ্রনাথের ছাপ ছিল। শমীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। সে বাড়িতে জোরে জোরে চিৎকার করে বাবার লেখা কবিতা আবৃত্তি করত। বাবার অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল। শমীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের নিয়মিত ছাত্র ছিল এবং সে এখানকার অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯০৭ সালে শমীন্দ্রনাথ সরোজচন্দ্র নামে তার এক সহপাঠীর মামার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেখানেই কলেরা রোগে শমীন্দ্রনাথ মারা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাবার আগেই মাতা বৌদি, স্ত্রী, দুই কন্যা এবং পুত্র শমীন্দ্রনাথকে হারিয়েছিলেন। এদের কেউই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায়নি। সবারই অকাল প্রয়াণ ঘটেছিল। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে কবি বারবার ঘর সামলেছেন। আবার নতুন করে তার ঘর ভেঙেছে। নিজেকে কবি ধূপের মতো পুড়িয়ে বাঙালি জাতির জন্য, বিশ্বের সব মানুষের জন্য জীবন ও জগতের অমোঘ সত্য উচ্চারণ করে গিয়েছেন তার নানা সাহিত্যকর্মে।

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও অধ্যাপক, পাংশা সরকারি কলেজ, পাংশা, রাজবাড়ি