রাশেদের প্রেম ও রাজনীতি একটি উপন্যাস। বইটির নাম দেখেই বোঝা যায়, ওর দুটি প্রধান উপাদান; একটি হলো প্রেম, অন্যটি রাজনীতি। এ দুইয়ের সমন্বয়ে উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাশেদের জীবন কাহিনির বাঁকে বাঁকে সমাজ-রাজনীতি, প্রেম-ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্বরূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে। যে কারণে রাশেদই এ উপন্যাসের প্রকৃত নায়ক। মাঝখানে নাফিসা-আনিসের আগমন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ধ্রুব তারার মতো উজ্জ্বল। এ যুগলের মাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা, অপরিসীম ত্যাগের মহিমা চিত্রায়িত হয়েছে। আনিস ভালো বাঁশি বাজাতে পারে। আনিসের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে, নাফিসা আনিসকে মন দিয়ে বসে। পরে যখন জানতে পারে আনিস অন্য একজনকে ভালোবাসে, তখন নাফিসা এক গভীর অন্ধকার খাদে পড়ে যায়। প্রায় আত্মহননের অবস্থা। পরে রহস্যের গিট খুলে আনিস যখন বলে, ‘আমি ভালোবাসি একটি শ্যামলী মেয়েকে’ তখন নাফিসা বুঝতে পারে এই শ্যামলী মেয়ে আর কেউ নয়, এ হলো, বাংলাদেশ-দেশমাতা। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ এটি। আনিস প্রাণবন্ত। অফুরন্ত, প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলো এই আনিস। যে কারণে নাফিসা শহরের পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েও আনিসের প্রেমের তরীতে ওঠে সহযাত্রী হতে দ্বিধা করেনি। শওকত যখন বলে, বুঝলে চাচা, আনিস হলো আধুনিক কালের কৃষ্ণ। তার বাঁশির টানে নব্য রাধা নাফিসা সে একেবারে মন জয় করে নিয়ে গেছে। তিনিও মন দিয়ে ফেলেছেন। তখন বুঝতে হবে একজন গ্রাম্য যুবকের ভালোবাসার শক্তি কত চুম্বকীয় এবং দৃঢ়। নাফিসার ভালোবাসাতে কোন খাঁদ ছিলো না। নাফিসা যখন বলে ‘তোমার আমার ভালোবাসার কোনো মৃত্যু নেই। যা-ই কিছু ঘটুক এ অদৃশ্য বন্ধন কোনো দিনও ছিন্ন হবে না। আমি তোমাকে কথা দিলাম, আমি তোমার জন্য আমৃত্যু অপেক্ষায় থাকব।’ আনিস যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হওয়ার পরও নাফিসা তার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুৎ হয়নি। আমৃত্যু আনিসের জন্য অপেক্ষা করেছে। উপন্যাসের বিস্তৃত পরিসরে আনিস-নাফিসার অধ্যায়টি ছোট হলেও পাঠকের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এর কারণ তাদের ব্যক্তিপ্রেমের মর্যাদা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ। বইটিতে প্রেম ও রাজনীতির কথা বলা হলেও, রাজনীতির প্রসঙ্গই প্রধান হয়ে ওঠেছে। লেখক নিজে একজন রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা। সারা জীবন তিনি রাজনীতি করেছেন। রাজনীতির অঙ্গনেই তার প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। তাই রাজনীতির অলিগলি ঘুরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, উপন্যাসে তারই নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন। উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যায়, শুধু তার জীবনের চার পাশের ঘটনা নয়। রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি প্রচুর অধ্যয়ন করেছেন। যে কারণে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বরে এসে উপন্যাসের সমাপ্তির ধারাবাহিকতায় যেসব তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তা গভীর অনুসন্ধিৎসা না থাকলে সম্ভব নয়। কাজেই এটি শুধু যেন-তেন একটি উপন্যাসের কাহিনি নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। রাজনীতির পাঠ যারা নিতে চান, তারা এ উপন্যাসটি পড়লে সমৃদ্ধ হবেন। দ্বিতীয়ত সামাজিক পরিবর্তনের কারণগুলো সম্পর্কেও অবহিত হবেন। উপন্যাসের ৩৯ পৃষ্ঠায় এসে প্রথম দেখা পাই রাশেদের রাজনৈতিক গুরু, সাহেদের। সাহেদের উপস্থিতির মাধ্যমেই উপন্যাসটির রাজনৈতিক উপাদান সচল হয়েছে। তারপর একে একে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, ৭৫-এর হৃদয় বিদারক ঘটনা, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার হত্যা, অতঃপর রাশেদের অনুশোচনামূলক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। রাশেদ যখন বলে, ‘জানি না আমরা কোন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জানি না, বাঙালির ললাট লিখন কী। রেবেকা, তোমার হাতেই সংসারের দায়দায়িত্ব আমি ছেড়ে দিলাম। মানুষের সঙ্গে ছিলাম, মানুষের সঙ্গেই আমাকে থাকতে দাও।’ তখন বোঝাই যায়, এটা শুধু রাশেদের উক্তি নয়, লেখক নিজেরও মর্মকথা এটি। শোকসন্তপ্ত আপামর জনসাধারণের কথা এটি। এখানে উপন্যাসটি জাতির মর্মবেদনাকে ধারণ করে স্বচ্ছ দর্পণ হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটির প্রথম থেকে ৩৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানে আছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। লেখক নিবিড়ভাবে সমাজ এবং চারপাশের ঘটনাবলীকে পর্যবেক্ষণ করে একটি ভাষিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। সামাজিক পটভূমি, রাজনৈতিক পটভূমি, ব্যক্তিক প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের যে অবয়ব তৈরি হয়েছে তাতে বইটি পাঠকপ্রিয় হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), কেন্দুয়া সরকারি কলেজ।