চন্দ্রাহত জ্যোৎস্নার পঙ্ক্তিমালা বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি

আনোয়ার কামাল

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সুইডেন প্রবাসী কবি, সাংবাদিক এবং কলাম লেখক দেলওয়ার হোসেন একজন পোড়খাওয়া জীবনবাদী মানুষ। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে নিজেকে শাণিত করেছেন তীক্ষè তরবারির মতো। চিকিৎসক পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। একজন শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে শহীদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন যখন ভূলুণ্ঠিত হয়, ঠিক তখনই তার কবি চিত্ত বেদনায় কুঁকড়ে ওঠে, প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত হয়। আমাদের যাপিত জীবনে সমাজের নানা অসঙ্গতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অনাচার তাকে ব্যথিত করে। হৃদয়ের গহীন কোণে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু কথামালা দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘চন্দ্রাহত জ্যোৎস্নার পঙ্ক্তিমালা’।

এ কবিতাগ্রন্থে সবগুলো কবিতাই পাঠককে মুগ্ধ করবে, কিঞ্চিৎ হলেও চেতনায় টোকা দেবে। প্রথম কবিতাগ্রন্থ হলেও পাঠক নিশ্চয় হতাশ হবেন না, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। দেলওয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৬০ সালে নীলফামারী জেলার রেল শহর সৈয়দপুরে। মা হামিদা বেগম, বাবা শহীদ ডাঃ এম এ আজিজ সরকার (জন্ম: ১৯২০, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের বেহবতপুর গ্রামে)। স্বাধীনতাকামী এই অকুতোভয় যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সৈয়দপুরে স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুপক্ষ বিহারিদের হাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

সেখানে ্যান্টনমেন্ট এলাকায় ৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে রেলওয়ে কলোনিতে নিজ নিবাস ও ডিসপেন্সারিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ও বিতরণ করে বিহারিদের টার্গেটে পরিণত হন। লেখক এই আত্মত্যাগী শহীদের চতুর্থ পুত্র সন্তান। লেখাপড়া করেছেন পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ি হাই স্কুল, সৈয়দপুর সরকারি টেকনিক্যাল হাই স্কুল এন্ড কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের শুরু থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করেছেন। ১৯৮০ সাল হতে বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখছেন। মূলত দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক সচিত্র স্বদেশ, দৈনিক বার্তা, ঢাকা ব্যুরো, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক ২০০০-সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে। বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠ সুইডেন প্রতিনিধি এবং কলামিস্ট হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও নিয়মিত কলাম লিখছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিন, উত্তর আমেরিকা সংস্করণ-এ। ১৯৮৯ সাল থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্মে বসাবাস করছেন। তিনি সুইডিশ ফরেন প্রেস এসোসিয়েশনের সদস্য। চাকরি করেছেন সুইডিশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ ধারক-বাহক দেলওয়ার হোসেন সুইডেন থেকে ‘প্রজন্ম একাত্তর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেছেন।

প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী লেখক নিয়মিত গল্প, কবিতা ও ছড়া লিখলেও রয়ে গেছেন প্রকাশ ও প্রচারের আড়ালে। তবে আত্মকথনে বিমুখ লেখক নৈতিক দায়বদ্ধতা কাঁধে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় বাবার অপ্রকাশিত বীরত্বগাঁথা এবং সৈয়দপুরে সংঘটিত নারকীয় গণহত্যার ওপর এক প্রামাণ্য দলিল ‘মোর নয়া মিয়া আর ফিরি আসপে না’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

আমরা তার এ গ্রন্থের কয়েকটি কবিতা পাঠ করব- অক্ষমতা যদি হতে পারতেম তোমার মতো গৃহত্যাগী নদী- তবে হয়ে যেতাম ভাঙ্গনের কাব্য গাঁথা লেখার উদাস বাউল কবি। ২. বিস্মৃতিমনে রাখার স্মৃতি আজ সুদূর অতীত, কেউ তো লেখে না এখন বুকের পাঁজর ভাঙ্গা দুঃখ জাগানিয়া গীত। ৩.গহীনের অশ্রুতুমি অতল বেদনার অশ্রু ঝরাও বুকে, আমি তো দেখি শুধু কালিমার কাজল- তোমার বিষণ্ণ চোখে। ৪. স্মৃতির শবনা হয় ছিন্ন হয়েছে বন্ধন- তাতে কী? তবুও তো মনে পড়ে তার মায়াবী কাজল চোখ, সুন্দর বিক্ষত হওয়া মনে- দেখি আজ স্মৃতির শব পড়ে আছে যেন হিমশীতল মৃত্যুর মতোই নিবর। ৫.শোকভরা বর্ষায় ভিজলো না চোখ। বারুদ বিস্ফোরিত আগুনে পুড়লো না হাত, খঞ্জরের আঘাতে রক্তাক্ত হলো না শরীর- তবে ঝরা ফুলের শোকে হলাম শোকার্ত অস্থির। ৬. উপমা কোথাও পেলাম না খুঁজে তোমাকে উজ্জ্বল-জ্যোৎস্নার সাথে মেলাবার উপমা, তুমি যে রয়ে গেলে শরতের বিষণ্ণ নীলিমা। ৭. দুঃখ বিলাসসাড়া শব্দহীন অনন্তের মৌনতায় যে- লালন করে সহিষ্ণুতা, হৃদয়হীন না হলে কেউ কি বলে তাকেদুঃখ বিলাসিতা? ৮. দিন শেষের ছায়া দুঃখ আর গেল কই? বেদনার আগুনে পুড়ে- পাঁজর করলাম অঙ্গার, দুঃখ এসে বলে এখন তো সময়- তোমার ওপারে যাবার! উপরের ২০টি কবিতা থেকে আমরা কবির যাপিত জীবনে সমাজের নানান ঘাত-প্রতিঘাতগুলো যে স্পর্শ করেছে- তারই এক সরল বয়ান উঠে এসেছে অবলীলায়।

এ কবিতাগ্রন্থে এমন মোট ২৬৯টি কবিতা স্থান পেয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৬। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা মাত্র। প্রতিটি কবিতাই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে। ‘এবং মানুষ প্রকাশনী’ থেকে জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থটি এখন রকমারি ডট কমসহ সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। কবিতাগ্রন্থটির চমৎকার দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন আল নোমান। কবির জন্য শুভকামনা রইল। কবিতাগ্রন্থটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি। কবিতার জয় হোক।

আনোয়ার কামাল

কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য আলোচক ঢাকা।